Advertisement
২৭ অক্টোবর ২০২৪
Financial Corruption

স্বাস্থ্য-দুর্নীতিতে কি কয়েক হাজার কোটি

সিবিআই সূত্রে খবর, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে দেওয়া ‘স্টেটাস রিপোর্টে’ আর জি কর হাসপাতালের বাইরেও দুর্নীতিচক্র ছড়িয়ে আছে বলে জানানো হয়েছিল (‘হাইলাইটস’ হিসেবে)।

স্বাস্থ্য ভবন।

স্বাস্থ্য ভবন। —ফাইল চিত্র।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:১০
Share: Save:

শুধুমাত্র আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালই নয়। গত ১০ বছর ধরে রাজ্যের অনেক সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে বলে তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। এবং ওই দুর্নীতির অঙ্ক কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বলেও তাঁদের দাবি।

সিবিআই সূত্রে খবর, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে দেওয়া ‘স্টেটাস রিপোর্টে’ আর জি কর হাসপাতালের বাইরেও দুর্নীতিচক্র ছড়িয়ে আছে বলে জানানো হয়েছিল (‘হাইলাইটস’ হিসেবে)। প্রধান বিচারপতি পর্যবেক্ষণে জানান, যদি আর জি কর হাসপাতালের বাইরে দুর্নীতির জাল থাকে, প্রয়োজনে তদন্ত করতে পারবে সিবিআই। সেই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

এক তদন্তকারী আধিকারিকের কথায়, আর জি কর হাসপাতালে আর্থিক দুর্নীতির মামলায় জেল হেফাজতে থাকা প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সুমন হাজরা, বিপ্লব সিংহের যোগাযোগের সূত্র পাওয়ার পরে আরও তথ্য উঠে আসতে থাকে। ওই আধিকারিক জানান, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অধ্যক্ষ থাকাকালীন সুমন-বিপ্লবের সঙ্গে সন্দীপের পরিচয় হয়েছিল বলে জানা যায়। সন্দীপ বদলি হয়ে আর জি করে আসার পরে ওই দু’জনকে ওই হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ-সহ চিকিৎসা সংক্রান্ত সামগ্রীর বরাত দেওয়া শুরু হয় বলে অভিযোগ। চলে টেন্ডার-দুর্নীতি। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশাপাশি ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওই দুই ব্যবসায়ী আর জি কর হাসপাতালে সক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ।

সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, গত প্রায় দশ বছর ধরে রাজ্যের বেশ কিছু সরকারি হাসপাতালে এমন সব ‘সুমন-বিপ্লব’ রয়েছেন বলে সূত্র পাওয়া যাচ্ছে। সিবিআই সূত্রে দাবি, ২০১৪ সালের পর সরকারি নীতি কিছুটা বদল করে ওষুধ এবং হাসপাতালের চিকিৎসা-সামগ্রী সরবরাহে স্বাস্থ্য ভবনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কিছুটা তুলে নেওয়া হয়। তা চলে যায় হাসপাতাল প্রশাসনের হাতে। ওই সিবিআই কর্তার দাবি, এরপর ওষুধ এবং চিকিৎসার সামগ্রী কেনাবেচার খেলায় ‘দুর্নীতির চারা ধীরে ধীরে বটগাছে’ পরিণত হয়। ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলেও তাঁর দাবি।

এক তদন্তকারী আধিকারিক বলেন, “সন্দীপের ক্ষেত্রে তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, স্বাস্থ্য ভবন এ ক্ষেত্রে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ।আর জি কর হাসপাতালে আধিকারিক এবং কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গিয়েছে, সন্দীপের দুর্নীতির তদন্ত প্রক্রিয়ার পর তাঁকে বদলি করা হয়েছিল। সেই নির্দেশ ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সন্দীপ ঘনিষ্ঠ আধিকারিকদের বলেছিলেন, এক মাসের মধ্যে তিনি ফিরে আসবেন। ফিরেও এসেছিলেন।” সে ক্ষেত্রে সন্দীপের ‘প্রভাবশালী যোগ’ স্পষ্ট বলেও সিবিআই সূত্রে দাবি। তদন্তকারীদের দাবি, সম্প্রতি ন্যাশনাল মেডিক্যাল, তারপর রাজ্য জুড়ে বেশ কিছু সরকারি হাসপাতালে এমন দুর্নীতি চক্র গড়ে উঠেছে বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সবিস্তার খোঁজখবর শুরু হয়েছে।

সিবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, ‘‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে অজগরের গর্তের হদিস পাওয়া গিয়েছে। এখন অজগরের মুখের কাছাকাছি পৌঁছনো গিয়েছে। অজগরের লেজ কত মোটা এবং লম্বা তা আন্দাজ করা হচ্ছে। তদন্তের অগ্রগতি অনুযায়ী ওই অজগরকে টেনে বার করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।” তাঁর দাবি, এ হল ‘সংগঠিত অপরাধ’।

২০১৪ সালের পর ওষুধ, চিকিৎসা-সামগ্রী সরবরাহকারী কয়েকটি ‘যোগ্য’ সংস্থাকে ওষুধ সরবরাহ করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। তেমন কয়েকটি সংস্থার কয়েক জন কর্মীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সিবিআই সূত্রের দাবি, সে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যোগ্য সংস্থাগুলির নামে টেন্ডার করা হয় এবং মুনাফার একটি অংশ তাদের সরাসরি দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে সমস্ত ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সামগ্রী সরবরাহ করেছে ভুঁইফোঁড় সংস্থা। ওই ‘যোগ্য’ সংস্থাগুলির আধিকারিকেরা বিল তৈরি করে তাতে সই করেছেন এবং সেই বিল স্বাস্থ্য ভবনে জমা দেওয়া হয়েছে। বিল অনুয়ায়ী স্বাস্থ্য ভবন থেকে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। সিবিআই সূত্রে দাবি, ওই সব সংস্থার কর্মীরা নাকি তাদের কাছে দাবি করেছেন যে ‘রাজনৈতিক চাপে’ তাঁদের ভুয়ো বিলে সই করে পাঠাতে হয়েছে। সেই বক্তব্য যাচাই করা হচ্ছে। সিবিআইয়ের ওই কর্তা বলেন, "কাগজে-কলমে সব কিছু ঠিক রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে নিম্ন মানের অথবা জাল ওষুধ দেওয়া হয়েছে।” হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি এ ভাবে করা হয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সূত্র পাওয়া যাচ্ছে বলে তাঁর দাবি।

তবে দুর্নীতির বিষয়ে সিবিআইয়ের তদন্তের ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন না স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। ঘরোয়া ভাবে তাঁদের বক্তব্য, ২০১৪ সালের পর থেকে নির্দিষ্ট হাসপাতাল তার প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আর্থিক অনুমোদনের আর্জি পাঠাত। নিয়ম অনুযায়ী তা বরাদ্দ করা হত। সে ক্ষেত্রে কিছু ক্ষমতা ছিল হাসপাতালের। ফলে হাসপাতালে দুর্নীতি হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে অবগত নয় স্বাস্থ্য দফতর।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE