কালীবাবুর বাজার। —নিজস্ব চিত্র।
জল-কাদায় প্যাচপেচে মেছোহাটায় চিত্র প্রদর্শনী! হাওড়ার এক মাছবাজারে শিল্পী হিরণ মিত্রের একক চিত্র প্রদর্শনী হতে চলেছে চলতি মাসে।
সাধারণ ভাবে চিত্র প্রদর্শনী বলতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গ্যালারির কথাই মনে আসে। সেখানে যাঁদের পা পড়ে, তাঁদের সঙ্গে শহরতলির মাছবাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে মিল খোঁজা দুষ্কর। কিন্তু সেখানেই নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন শিল্পী হিরণ। কেন? হিরণ বলেন, ‘‘প্রচলিত যে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা, তাকে ধাক্কা দিতেই আমার এই পরিকল্পনা। ছবিকে এলিট শ্রেণির ঘেরাটোপ থেকে একেবারে সাধারণের কাছে নিয়ে আসতে চাই। আমি মনে করি, সব শ্রেণিকে সঙ্গে নিয়েই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেই কারণেই মাছবাজারকে বেছে নেওয়া।’’ গত বছরেও শিল্পী ওই বাজারেই দু’দিনের জন্য প্রদর্শনী করেছিলেন। সেটা পরীক্ষামূলক ছিল। সাড়া মেলায় এ বার পরিকল্পনা করেই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন।
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি হাওড়ার কালীবাবুর বাজারে একটি প্রদর্শনী করেছিলেন হিরণ। আগে থেকেই তৈরি ছবি থেকে বাছাই ২০টি নিয়ে সাজিয়েছিলেন মাছবাজার। এ বার তেমন নয়। হিরণ জানিয়েছেন, এই প্রদর্শনীর পরিবেশ মাথায় রেখেই তিনি নতুন ৩১টি ছবি এঁকেছেন। ‘আর্ট ইন এভরিওয়ান’ নামক প্রদর্শনীতে ছবি থাকবে মাছবিক্রেতাদের সাজানো পসরার ঠিক উপরে। মেঝেতে রুই, কাতলা, ইলিশ, বাটা থাকবে। তার ঠিক উপরেই ঝুলবে ক্যানভাস। শিল্পী জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছবি জায়গা পাবে প্রদর্শনীতে। যার সৃষ্টি হয়েছে মাছবাজারের কোলাহলের কথা ভাবনায় রেখেই।
হাওড়া ময়দানের কাছেই কালীবাবুর বাজার। বয়স নয়-নয় করেও আড়াইশো বছর। স্থানীয় জমিদার বংশের কালীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাজারটি তৈরি করেছিলেন। ভিতরে গৃহস্থালির সামগ্রী থেকে সব্জি বা মাছ— সবেরই আলাদা আলাদা বাজার রয়েছে। এখন ১৩১ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাঁদেরই সংগঠন ‘কালীবাবুর বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি’ তৈরি হয় ১৮৯১ সালে। শতাব্দীপ্রাচীন সেই সমিতিই এই প্রদর্শনী আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা। সমিতির সম্পাদক রতিকান্ত বর বলেন, ‘‘আমরা এই প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পেরে খুব আনন্দিত। বাইরের লোকেরা আমাদের বাজারে আসবেন। যাঁরা ছবি বোঝেন, তাঁরা নানা কথা বলবেন। সে সব আমরা শুনব।’’
রতিকান্ত জানান, হাওড়ার একটি নাট্যসংস্থার মাধ্যমেই হিরণ ও মাছবাজারের যোগাযোগ। প্রস্তাব শুনে রাজি হয়ে যায় মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি। তবে আগের বার তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়েছিল বলে সে ভাবে আয়োজন করা যায়নি। এ বার ৯ থেকে ১১ জুলাই দুপুর বাদ দিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজারের সঙ্গে প্রদর্শনী চলবে। সন্ধ্যায় যে হেতু বাজারে বেশি ভিড় থাকে না আর অল্প দোকান খোলে, তাই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে। ওই নাট্যসংস্থার পক্ষে বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘আমরা অনেক কিছুই ভেবেছি। সন্ধ্যায় নাটক, কবিতা পাঠ, গান হবে। কয়েকটি ছোট পত্রিকার স্টলও বসতে পারে। প্যালেস্তাইন পরিস্থিতি নিয়েও একটি নাটিকা হবে।’’
বাজারের মধ্যে প্রদর্শনী হলেও এখানে বিকিকিনির ব্যাপার নেই। শুধুই প্রদর্শনী। হিরণ বলেন, ‘‘আমি বাজারে যাচ্ছি না। বাজার আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। লে-লে বাবু ছ’আনাও নয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এটা একটা রগড় বলতে পারেন। মাছবাজারে কিছু আঁকিবুকি ঝুলিয়ে রাখা। যেগুলো মর্গের মতো সাদা সাদা দেওয়ালে মড়া ঝোলার মতো ঝুলে থাকার কথা, তারা চলে আসবে জীবন্ত মাছবাজারে। আগে যেমন চণ্ডীমণ্ডপে গাঁয়ের মানুষজন গল্পগাছার আসর জমাতেন, তেমনই আমরা ছবির আসর বসাব।’’
নাট্যসংস্থার সদস্যেরা প্রদর্শনী নিয়ে আরও আশাবাদী হাওড়া ময়দান পর্যন্ত মেট্রো রেল চালু হয়ে যাওয়ায়। তাঁরা মনে করছেন, কলকাতা-সহ নানা জায়গার মানুষ সহজে চলে আসতে পারবেন প্রদর্শনীতে। হাওড়া ময়দান মেট্রো স্টেশন থেকে কাছেই নেতাজি সুভাষ রোডের উপরে কালীবাবুর বাজার। একটু ঢুকলেই আঁশটে গন্ধ বলে দেবে ছবির প্রদর্শনী কোন দিকে। কিন্তু কালীবাবুর বাজারের মানুষ কি বুঝবেন রং-তুলিতে ফুটে ওঠা শিল্পীর ভাবনার গূঢ় অর্থ? প্রশ্নের জবাবে তিন পুরুষের মৎস্য ব্যবসায়ী রতিকান্তের জবাব, ‘‘জামার নকশা দেখে ভাল লাগলেই তো সবাই কেনেন। তখন কি সেই নকশার মানে বুঝতে চান? ফলে ছবি আর প্রদর্শনী ভাল লাগল কি না সেটাই আসল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy