ভিড়: মইনুল মণ্ডলের বাড়ির সামনে। জলঙ্গির মধুবোনা গ্রামে। (ইনসেটে) কালীনগর গ্রামে মুর্শিদ হাসানের বাড়ি। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম
দেশের শেষ ভূখণ্ড থেকে ঢিল ছোড়া দূরে বেরং হয়ে দাঁড়িয়ে ইংরাজি ‘এল’ আকৃতির ঢাউস যে বাড়িটা, তার বারান্দা থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় বাংলাদেশের তালপাটি গ্রাম। সীমান্তের মধুবোনা গ্রামের মইনুল মণ্ডলের ওই ভিটে থেকে হাঁটা পথে পড়শি দেশের কুষ্টিয়া জেলায় পা রাখতে বড়জোর মিনিট পনেরো লাগে। এনআইএ-র দাবি— আর আধ-ঘণ্টাটাক দেরি হলে হেঁটে নিশ্চিন্তেই সীমান্ত পেরিয়ে যেত মইনুল।
যা শুনে সদ্য বাঁধানো সিঁড়িতে বসে মইনুলের স্ত্রী মাফরোজা বলছেন, ‘‘রাতবিরেতে কেন, পালানোর হলে তো কবেই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে হারিয়ে যেত! একটা সংসারী মানুষকে ধরে এখন গল্প ফাঁদছে পুলিশ (এনআইএ)।’’
শুক্রবার রাতে, আল কায়দা জঙ্গি সন্দেহে ধৃত মইনুল যে সংসারি, তা কবুল করছেন গ্রামের আর পাঁচ জনেও। তবে, একটা প্রশ্ন ঝুলিয়ে দিচ্ছেন সকলেই— এমন প্রান্তিক গ্রামে নিতান্ত সংসারী একটা মানুষের কয়েক বছরে এমন বিপুল বৈভব হল কী করে! বছর কয়েক আগেও দরমার বেড়া আর খড়ের চালার ঘর এখন ছ’কামরার দালান কোঠা। ঝলমলে টিউবলাইটের সঙ্গে টিভি-ফ্রিজ। মইনুলের এক পড়শি বলছেন, ‘‘লকডাউনের সময়ে গ্রামে ফিরে নতুন করে কয়েক বিঘা জমি কেনার তোড়জোড়ও শুরু করেছিল মইনুল।’’ মধুবোনার নিম্নবিত্ত মানুষের জনপদে মইনুল যে ক্রমেই কেউকেটা হয়ে উঠছিল, তা নজর এড়ায়নি অনেকেরই। শনিবার ভোরেই গ্রাম ছেড়ে কলকাতা রওনা হওয়ার কথা ছিল তার। বিকেলের বিমানে এর্নাকুলাম যাওয়ার সাড়ে সাত হাজার টাকার টিকিটও কেটে রেখেছিল সে। তার সঙ্গেই কেরল থেকে ফেরা এক পরিযায়ী শ্রমিকের কথায়, ‘‘কেরলে না ফিরলে পেটে ভাত জুটবে না। কিন্তু বাসের ভাড়া জোগাড় করতে পারছি না বলে আমরা গ্রামেই পড়ে আছি। আর মইনুল বিমানের টিকিট কেটে বসল!’’
আরও পড়ুন: জেএমবি-র ছাতা বদল, রাজ্যে এল আল কায়দা
লকডাউনে থমকে যাওয়া পাকা দেওয়ালে এখনও রং পড়েনি। বেরং হয়েই পড়ে রয়েছে বারান্দাজোড়া লতাপাতার নকশা কাটা গ্রিল। বাড়ির উঠোন তবু রঙিন হয়ে আছে ঝাঁকড়া পেয়ারা গাছের সবুজ ছায়ায়। সেই ছায়ায় বসে মইনুলের বাবা সারফান মণ্ডল বলছেন, ‘‘বছর দশেক আগে রুজির টানেই মইনুল পাড়ি দিয়েছিল ভিন্ রাজ্যে। প্রথমে রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও পরে একটা বড় হোটেলে কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল, লুচি-পরোটা তৈরির কাজ। পরোটা বেলতে বেলতে কখন আর জঙ্গি সংগঠনের কাজ করবে বলো তো বাবা!’’
দাদার হাত ধরেই সারফানের অন্য দুই ছেলে আইনুল আর আরফানও এখন কেরলে কাজ করেন। লকডাউনে দাদার সঙ্গেই গ্রামে ফেরা আইনুলের দাবি, ‘‘সারা বছর খেটে ইদের সময়ে গ্রামে ফিরি আমরা। তিন ভাই মিলে বাড়িতে প্রায় হাজার চল্লিশ টাকা পাঠাই, তাতেই বাড়িটা পাকা হয়েছে। লোকের চোখ টাটাচ্ছে তাতে।’’ গ্রামের প্রবীণ মানুষ সারাফাত মণ্ডল বলছেন, ‘‘এ গ্রামের অনেকেই তো কেরলে কাজ করেন, এমন ঠাটবাট অবশ্য করতে পারেননি তাঁদের কেউ-ই।’’
আরও পড়ুন: বিএসএফ মেরে বন্দুক লুটের ছক কষেছিল জঙ্গিরা
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, কেরলে থাকার সময়েই মইনুলের সঙ্গে আলাপ হয় মুর্শিদ হাসানের। দু’জনেই ছিল নাশকতার মাথা। গাজওয়াত-উল-হিন্দের সঙ্গে যোগসাজশের সূত্রেই তারা আল কায়দার ভারতীয় শাখার সংস্পর্শে এসেছিল বলে গোয়েন্দারা জানান। তবে, মধুবোনা থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে কালীনগর গ্রামে মুর্শিদের বাড়ির চালচিত্র দেখলে দু’বাড়ির বৈপরীত্যটা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। পাটকাঠি আর দরমা দিয়ে ঠেস দেওয়া সে বাড়ির চালায় অজস্র ফুটো। বৃষ্টি ও রোদ বাঁচাতে ছাদে আড়াআড়ি বিছানো হয়েছে তস্য ছেঁড়া পলিথিনের চাদর।
পড়শিরা বলছেন, ‘‘ছেলেটা একেবারে বাবার মতো। কোনও উদ্যোগ নেই। কলাবাগানে বাবার সঙ্গে যেত বটে, তবে গাছের ছায়ায় সময় কাটাত।’’ কালীনগরের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, ‘‘মুর্শিদের বাবাও মতিনও বড় ঘরকুনো লোক। দু’দিন কাজ করলে পাঁচ দিন বসে থাকে।’’ স্কুলে পা পড়েনি মুর্শিদের। তার খেলাধুলোর সাথীরাও জানাচ্ছে, নির্বিবাদী ছেলেটা কোনও দিন কারও সঙ্গে হাতাহাতিতেও জড়ায়নি। গ্রামে থাকার সময় অ্যান্ড্রয়েড তো দূরস্থান বাড়িতে সাধারণ একটা ফোনও ছিল না তাদের। সেই মুর্শিদকেই এমন ‘জঙ্গি’ হয়ে উঠতে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছেন তাঁরা।
তবে মুর্শিদের সঙ্গে সে গ্রামেরই দর্জি আবু সুফিয়ানের ‘বন্ধুত্ব’ কারও অজানা নয়। আবুকেও শুক্রবার পিছমোড়া করে ধরে নিয়ে গিয়েছে এনআইএ। আবুর ছেলে ওয়াসিম বলছে, ‘‘রবিবার রাতে ফের এসেছিল পুলিশ (এনআইএ)। কিছু বইপত্র এবং বাবার ঘরে ওই গর্ত থেকে আরও কিছু বিদ্যুতের তার নিয়ে গিয়েছে। যাওয়ার সময়ে বলে গিয়েছে, ‘ভয়ের কিছু নেই। তোমার বাবা ভাল আছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy