প্রতীকী ছবি।
ঠাকুরমশাই নেই ঠিকই! তবু পুজো বটে! লাল পাড়, সাদা শাড়িতে সাজানো কন্যা ‘গঙ্গা’-কে তাই জোড় হাতে প্রণাম আর গায়ে হাত ছুঁইয়ে আদর দুইই করলেন জন্মদাতা পঞ্চানন মণ্ডল।
এ মেয়ের জন্মই সমুদ্দুরে যাবে বলে। তবে এ যাত্রা যেতে হবে গুজরাতের পুরাতাত্ত্বিক ক্ষেত্র লোথালে ন্যাশনাল মেরিটাইম হেরিটেজ কমপ্লেক্সে। ভারতীয় সভ্যতার নৌ ইতিহাসের গরিমা মেলে ধরতে প্রধানমন্ত্রীর সাধের প্রকল্পে ঠাঁই পাবে বাংলার নৌ ঐতিহ্যের স্মারক। অত দূরে গিয়ে মেয়েকে কোনওদিন দেখা হবে কি না, কে জানে! রূপনারায়ণের চরে বাংলার সাবেক সমুদ্রগামী ছোট্ নৌকাটি প্রথম বার জলে পড়ার প্রাক্কালে স্রষ্টা পঞ্চানন মণ্ডলের চোখ চিকচিক করে। হাঁটুর উপরে পেরেক ফোটার দাগ দেখিয়ে বলেন, “আমার রক্ত নিয়েছে। নিজের মেয়ের থেকে কম কিসে! নাম রেখেছি গঙ্গা!” নৌকার শরীর তিলে তিলে গড়ে জলে ভাসানোর আগে বাংলার রীতি মেনেই হেড-মিস্ত্রি নিজে পুজো করলেন বৃহস্পতিবার।
রূপনারায়ণের ও পারেই প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যশালী তাম্রলিপ্ত বন্দর (আজকের তমলুক)। এ পারে হাওড়ার শ্যামপুরে রূপনারায়ণ লাগোয়া ডিহিমঙ্গলঘাটে সাবেক বাংলার নৌকা গড়ার একটি আড়ত। পঞ্চাননের ঠাকুরদার বাপের আমলেও তৈরি হয়েছে ছোট্ নৌকা। তবে এখন দশ ঘর কারিগরও মিলবে না! মাঝসমুদ্রেও মায়ের কোলের মতো নিশ্চিন্তে বসতে পারে ছোট্। আর একটু হাওয়া পেলে জল কেটে ছুটতে পারে তরতরিয়ে। তবে ট্রলার যুগ শুরুর পরে ছোট্-এর ‘দিন গিয়াছে’।
নৌকা বিশারদ তথা ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের (অ্যানথ্রপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া) গবেষক স্বরূপ ভট্টাচার্য বলছিলেন, "উনিশ শতকের কলকাতার ছবিতেও ছোট্ দিয়ে বড় ডিঙি নৌকা টানতে দেখা যায়।" এনডেঞ্জার্ড নলেজ মেটিরিয়াল প্রোগ্রাম বা বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় সামগ্রী ও কলাকৌশল সংরক্ষণের একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্পে গত এক মাস ধরে ব্রিটিশ মিউজ়িয়মের জন্য ছোট্ তৈরির প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপের ডিজিটাল নথি তৈরি হয়েছে শ্যামপুরে। স্বরূপের সাহায্যেই গবেষণার কাজে শামিল হয়েছেন এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিটাইম আর্কিয়োলজির অধ্যাপক জন কুপার, সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জিশান আলি শেখেরা।
পঞ্চাননের নেতৃত্বেই তাঁর চার ছেলে অমল, মনোমোহন, দিলীপ, দীপক ছোট্ গড়ছেন রূপনারায়ণের চরে। জন মুগ্ধ, “সত্তর পার করা বৃদ্ধের হাতুড়ির ঘায়ে সাংঘাতিক জোর!” গায়ের চামড়া ঢিলে হলেও সুঠাম দেহের পেশি। পঞ্চানন বলেন, “শ্যামপুরে শেষ বার ছোট্ আমারই হাতে তৈরি। তিরিশ বছর আগে। তবে তার আগে শ’খানেক ছোট্ গড়েছি। তাই ব্রাহ্মণ পুরোহিতের পুজোর মন্ত্রের মতো পর পর কী করতে হবে চোখে লেগে থাকে।”
তবে এ তল্লাটে নদীরও নাব্যতা নেই। এ কালে এমন নৌকা কদাচিৎ তৈরি হয় পূর্ব মেদিনীপুরে মন্দারমণির কাছে দেউলিতে। স্বরূপদের আফশোস, বাংলার নৌ ঐতিহ্যের স্মারক নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রকল্প হলেও তা পশ্চিমবঙ্গে কোথাও যত্নে রাখার পরিকাঠামো মেলেনি। তবে গুজরাতের মেরিটাইম মিউজ়িয়মে ছোট্ নৌকা নিয়ে যেতে আগ্রহী হয়েছেন কেন্দ্রীয় প্রকল্পটির উপদেষ্টা পুরাতত্ত্ববিদ বসন্ত শিন্ডে। তিনি আনন্দবাজারকে বলেছেন, “নৌ বাহিনীর সাহায্যে নৌকাটি কলকাতা হয়ে সড়ক পথে যেতে পারে। তবে জলপথে পশ্চিম উপকূলে নিয়ে যাওয়ার দিকটাও খতিয়ে দেখছি।”
সৃষ্টির পরে এখন বাংলার কন্যাকে বিদায় জানানোর প্রহর গুনছেন প্রবীণ স্রষ্টা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy