পায়েল সিং মোহাঙ্কা এবং সাগরিকা ঘোষ
সম্প্রতি প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত হল ‘অ্যান অথরস্ আফটারনুন’। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে ছিলেন সাম্প্রতিক কালে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা লেখক-সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষ। তাঁর লেখা বই ‘ইন্দিরা: দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল প্রাইম মিনিস্টার’ নিয়ে এক আলোচনায় দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে সাগরিকা বলেন, “তিনি গণতন্ত্র ভালবাসতেন, আবার বাসতেনও না।” শ্রী সিমেন্ট-এর সহযোগিতায় আয়োজিত হয় এ দিনের অনুষ্ঠান। যার ডিজিটাল পার্টনার ছিল আনন্দবাজার অনলাইন।
অগ্নিকন্যা সাগরিকা ঘোষের সাংবাদিক জীবনের ব্যাপ্তি তিরিশ বছরেরও বেশি। ১৯৯১ থেকে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। ‘টাইমস অফ ই্ন্ডিয়া’, ‘আউটলুক’ ও ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ কাজ করেছেন। ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ছিলেন সিএনএন-আইবিএন-এর প্রাইম টাইম সঞ্চালক। বর্তমানে টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন সাগরিকা। সম্প্রতি, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তৃণমূল কংগ্রেস-এর (টিএমসি) রাজ্যসভা সদস্য নির্বাচিত হওয়া তাঁর মুকুটে আরও একটি পালক যোগ করেছে।
সাংবাদিক ও লেখক পায়েল সিং মোহাঙ্কার সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে সাগরিকার বই, কর্মজীবন, অনুপ্রেরণা ও রাজনৈতিক জীবন। তারই সূত্রে তিনি বলেন, “ভারতের গণতন্ত্রে যা ঘটছে, সেই সম্পর্কে আমি চিন্তিত।”
সাগরিকা যখন সাংবাদিকতা শুরু করেন, তিনি কল্পনাও করেননি যে এক দিন রাজনীতিবিদ হবেন। সরকারের তীব্র সমালোচক হিসেবে এমনটা ভাবনাতেও আসেনি কখনও। কিন্তু দেশ পরিচালনার শোচনীয় পরিস্থিতি দেখে এ বার রাজনীতিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
সাগরিকার কথায়, “রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আমি ছিন্নভিন্ন করেছি আমার কাজে, লেখায়। রাজনীতিবিদের জীবনীতে আমি তাঁদের কাটাছেঁড়া করেছি। ফলে, রাজনীতিতে যোগ দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু প্রস্তাবটা (রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার) এলে সেটাকে একটা বড় স্বীকৃতি হিসেবে দেখি। এ-ও মনে হয় যে, আমার নিজের রাজ্যের প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। ভারতের গণতন্ত্রে, আমাদের গণমাধ্যমে এবং আমাদের নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে যা হচ্ছে, তা আমায় চিন্তিত করে তোলে। তাই মনে হয়েছে, এটাই উপযুক্ত সময়। বিশেষত আমি যখন তিন বছর নিউজরুমের বাইরে আছি।”
সাগরিকাকে যা ভাবিত করে তুলেছে, তা হল শাসন ব্যবস্থার বাড়াবাড়ি। যার ফলে ব্যক্তি জীবনের সব ক্ষেত্রেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাস্তব হয়ে উঠছে। তিনি মনে করেন, ‘ভবিষ্যৎ হবে ফেডেরাল’ এবং রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি সরকারের ক্ষমতা কমানোর চেষ্টা করবেন।
সাগরিকা আরও বলেন, “আমরা কী খাব, লিখব, কী পরব, ভালবাসব, কাকে বিয়ে করব, কী ভাবে জীবন যাপন করব, কী পড়ব, তা সরকারর ঠিক করে দেওয়া উচিত নয়। উত্তরাখণ্ডের কথাই ধরুন না। সেখানে দুই ব্যক্তি সহবাস করতে চাইলে, রেজিস্ট্রারের অনুমতি নিতে হবে। এবং সেই সম্পর্ক ভেঙে গেলে তার অবসান ঘটানোর বেলাতেও তাঁর সম্মতি নিতে হবে। কেন এক জন সরকারি আধিকারিক একটি সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন? এই ব্যবস্থা দুর্নীতির জন্ম দেয়। আমি শাসন ব্যবস্থার অতি সক্রিয়তার বিরোধিতা করি এবং সরকারের ক্ষমতা কমানোই আমার লক্ষ্য।”
তাঁর দুই আত্মীয় (কাকীমা) তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন সাগরিকাকে। এক জন অরুন্ধতী ঘোষ ও দ্বিতীয় জন রুমা পাল। অরুন্ধতী ছিলেন প্রাক্তন কুটনীতিবিদ আর রুমা ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। দৃঢ়চেতা মহিলাদের সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠায় সাগরিকার মধ্যে এই ধারণা জন্মায় যে, চাইলে মহিলারা যা চাইছেন, তা-ই করতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যমূলক প্রথার বিরোধিতা করতে পিছপা হন না।
সাগরিকার কথায়, “অক্সফোর্ড থেকে পাস করে কাজে যোগদান করার পর আমায় কয়েক দিন কেবল ম্যাগাজিনের পাতা উল্টেপালটে দেখতে বলা হয়। এবং আমার পুরুষ সহকর্মীদের রাজনৈতিক সমাবেশের খবর করতে পাঠানো হত। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মীদের বলতে বাধ্য হই যে, আমিও মাঠে-ময়দানে গিয়ে খবর করতে চাই। ১৯৯১ সালে সাংবাদিকতা ছিল পুরুষ-প্রধান। টেলিভিশনের প্রসারের ফলে অনেক মহিলা সাংবাদিক এগিয়ে আসতে থাকেন। তবুও আমি বলব যে, এ ক্ষেত্রে একটা গ্লাস সিলিং আছে। তা ছাড়া আমি এক কাঁচের ক্লাবের অস্তিত্বের কথা বলি। সেখানে দিনের শেষে পুরুষরা জড়ো হয়ে তাঁদের গ্লাস তোলেন। সে জায়গায় মহিলাদের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে, মহিলারা একটা পর্যায় অবধি এগোতে পারেন। তার পর আর এগোনো যায় না।”
তাই সাগরিকা মনে করেন যে, মহিলাদের উচিত খানিকটা ‘কৌশলগত পাগলামি’ আয়ত্ত করা, যা তাঁদের কর্মজীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তিনি বলেন, “যদি আপনি সফল হতে চান, তা হলে একটু পাগলামি, একটু অন্য রকম আচরণ করা দরকার বা একটু ছিটিয়াল হতে হবে। আপনাকে একটু অস্বাভাবিক মনে হলে, সবাই আপনাকে আপনার মতো চলতে দেবে। তাঁদের মনে হবে, ‘ওঁকে ওঁর মতো চলতে দাও। কাজ করার একটা নিজস্ব ধারা আছে ওঁর। সেটা ওঁকেই বুঝে নিতে দাও’। তাই আমি সুযোগের জন্য ও কাজ করার জন্য জোরাজুরি করতাম। আমি তার উপরেই নির্ভর করেছি। কাজে ডুবে থাকতে আমার ভাল লাগে।”
তাঁকে সমর্থন ও অনুপ্রাণিত করার জন্য সাগরিকা তাঁর দুই প্রাক্তন সম্পাদক – বিনোদ মেহতা ও দিলীপ পাডগাওঁকারকে কৃতিত্ব দেন। তা ছাড়া, তাঁর স্বামী, বিশিষ্ট সাংবাদিক রাজদীপ সরদেসাই শুধু যে তাঁকে সমর্থন জুগিয়েছেন তা নয়, সাগরিকা সম্পর্কে তাঁর স্বামীর রয়েছে সীমাহীন গর্ব।
জাগারনট বুকস-এর চিকি সরকার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরই সাগরিকা ‘ইন্দিরা: ইন্ডিয়াজ মোস্ট পাওয়ারফুল প্রাইম মিনিস্টার’ বইটি লিখতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মশতবর্ষে বইটি প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাগরিকা জানান, ইন্দিরা গান্ধীর অসামান্য রসবোধ ছিল। তিনি শাড়ি খুব পছন্দ করতেন। সাহসের প্রতীক ছিলেন ইন্দিরা।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর জীবনী সম্পর্কে সাগরিকা বলেন, “এক জন চরিত্রকে দেখার মতো করেই আমি তাঁর জীবনকে দেখি। তাঁর বাবা ও স্বামীর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর ছিল এক জটিল সম্পর্ক। তাঁর চরিত্র বর্ণনা করতে হলে আমি বলব, তিনি ছিলেন এমনই এক ব্যক্তি, যিনি কোনও কিছুকে একই সঙ্গে ভালবাসতেন, আবার অপছন্দও করতেন। তিনি ভারতের গণতন্ত্রকে ভালবাসতেন, আবার বাসতেন না। বলতেন, তিনি ভারতের সংবাদ মাধ্যমকে ভালবাসতেন, আবার ততটা ভালবাসতেনও না। ফিরোজ গান্ধী সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। হ্যান্ডলুম শাড়িতে ইন্দিরাকে আসল ‘দাবাং’ মনে হত।”
অটলবিহারী বাজপেয়ীকে নিয়ে লেখা তাঁর বই, ‘অটলবিহারী বাজপেয়ী: ইন্ডিয়াজ মোস্ট লাভড প্রাইম মিনিস্টার’ সম্পর্কে সাগরিকা বলেন, রীতিবিরুদ্ধ পছন্দ ও হাস্যরসের জন্য বাজপেয়ী প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর কথায়, “বাজপেয়ীর কৌতুকের সঙ্কলন একটি বই হয়ে যেতে পারে। উনি সারা জীবন রাজকুমারী কাউল-এর সঙ্গে কাটালেন, যিনি আবার তাঁর স্বামী ও দুই মেয়ের সঙ্গে থাকতেন। এক সময়ে শ্রীমতি কাউলকে এক জন সাংবাদিক এই নিয়ে প্রশ্ন করলে বাজপেয়ী চটজলদি উত্তর দিয়ে বলেন, ‘কাশ্মীর জ্যায়সা মামলা হ্যায় (কাশ্মীরের মতো পরিস্থিতি এটা)’। তার ফলে আরএসএস ও পুরুষতন্ত্র চটে যায়। কিন্তু তাতে বাজপেয়ীর কিছু আসে যায়নি! এক অন্য ধরনের বিজেপি তৈরি করতে তিনি কৌতুক রসের সাহায্য নেন।”
এক মনোগ্রাহী প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়। ইন্ডিয়ান ফোক আর্ট-এর পরামর্শদাতা কিউরেটার নন্দিতা পালচৌধুরী সাগরিকা ঘোষ ও পায়েল মোহাঙ্কাকে সম্মান প্রদান করেন।
তাজ বেঙ্গলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কে মোহনচন্দ্রন বলেন, “সাগরিকার কথা শুনে খুব আনন্দ পেলাম। জীবনী লেখা কখনওই সহজ হয় না বলেই আমার মনে হয়। শুধু যে রিসার্চ করতে হয়, তা নয়। কোন ঘটনা ও তথ্য রাখব আর কোনটা বাদ দেব, সেই সিদ্ধান্তও নিতে হয়। একই সঙ্গে নিরপেক্ষ ও নিরাবেগ থাকা খুবই কঠিন। এখন, অটলবিহারী বাজপেয়ী ও ইন্দিরা গান্ধীর উপরে লেখা তাঁর দু’টি ভাল বই তাঁর ঝুলিতে এল।”
নন্দিতার কথায়, “আমি অনেক দিন ধরেই সাগরিকা ঘোষ, তাঁর বাবা ও তাঁর পরিবারের খুব অনুরাগী। আজকের আলোচনা আমার সেই অনুভূতি বাড়িয়ে দিল। আমার এ কথা ভেবেই আনন্দ হচ্ছে যে, নিজস্ব চিন্তা ও প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নিয়ে এক জন সংসদে প্রবেশ করছেন। আমি তাঁর অবদানের দিকে তাকিয়ে আছি। এটা খুবই উৎসাহিত ও আশা জাগানোর মতো অনুষ্ঠান।”
প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন-এর উত্তর-পূর্বের সাম্মানিক আহ্বায়ক এষা দত্ত বলেন, “আজকের অনুষ্ঠান বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে কারণ, সাগরিকা কেবল এক জন সাংবাদিকই নন, উনি রাজনীতিতেও পা রেখেছেন। এক জন সাংবাদিকের তুলে ধরা পরিপ্রেক্ষিতের সুবিধে হল তাঁরা সব দিক দেখতে পান। আজকের রাজনীতি সম্পর্কে ওঁর মতামত আমি খুব উপভোগ করেছি। আমি ওঁর বইটি পড়ার অপেক্ষায় আছি।”
মনোবিশেষজ্ঞ মীতা শেঠিয়ার কথায়, “আরও সময় পেলে ভাল হত। তা হলে আমরা আরও জানতে পারতাম। কারণ গণমাধ্যম যা দেখায়, বিশ্বের মানুষ তা-ই জানার সুযোগ পায়। পায়েল মোহাঙ্কা ও সাগরিকা ঘোষ দু’জনেই ছিলেন অসাধারণ। তাঁদের আলোচনা এত সুন্দর ভাবে এগোয় যে, মনেই হয়নি এটাই তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ।”
এহসাস উওম্যান, কলকাতা নিশা আগরওয়াল বলেছেন, "অত্যন্ত মনোগ্রাহী অনুষ্ঠান হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতি ও তার বিকাশের ওপর আলোকপাত করেছেন সাগরিকা। তিনি তাঁর কর্মজীবন, কী ভাবে আরও বেশি সংখ্যায় মহিলারা সাংবাদিকতায় আসছেন, সব নিয়েই বলেছেন। এবং অচিরেই যে লিঙ্গ বৈষম্যে সমতা আসবে, আমাদের তা জানিয়েছেন। আমায় তা খুবই আকর্ষণ করেছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy