রবিবার বৌবাজারে নির্বাচনী জনসভায়। ছবি: সুমন বল্লভ
তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীকেই সারদা-হাতিয়ারে লাগাতার বিদ্ধ করে চলার নির্দেশ দিয়ে গেলেন নরেন্দ্র মোদীর সেনাপতি। আর সেই নির্দেশ পাওয়ার অব্যবহিত পরেই কলকাতার রাস্তায় বিজেপি কর্মীরা স্লোগান তুলে দিলেন ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, মমতা ব্যানার্জি চোর হ্যায়’! ঠিক যেমন হয়েছিল রাজীব গাঁধী জমানায় বফর্স কেলেঙ্কারির সময়ে!
কলকাতায় এসে রবিবার দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে এবং পরে বৌবাজারে নির্বাচনী জনসভায় বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ যা বলে গেলেন, তার নির্যাস তৃণমূলকে সূচ্যগ্র ভূমিও ছাড়া যাবে না। সারদা কেলেঙ্কারির প্রতিবাদে তৃণমূল স্তরে লাগাতার আন্দোলন করে অতিষ্ঠ করে দিতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর বাহিনীকে। বুথ স্তরে প্রতিবাদ হবে, সারদা-মমতা যোগ নিয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে স্লোগান লিখতে হবে। এই পথেই ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে দখল করতে হবে পশ্চিমবঙ্গের তখ্ত। এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে কোনও শৈথিল্য দল বরদাস্ত করবে না বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন অমিত। লোকসভা ভোটের প্রচারে এসে সারদা নিয়ে যে সুর বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে রাজ্যে এসে অমিত সেই সুরই আরও সপ্তমে চড়িয়ে গেলেন।
বিজেপি সভাপতি হওয়ার পরে প্রথম বার কলকাতায় এসে অমিত সওয়াল করেছেন, সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন যদি তৃণমূলের পক্ষে ‘পরিবর্তন’ ঘটানোর জন্য অনুঘটক হতে পারে, অনেক বেশি মানুষের ক্ষতি করে সারদা-কাণ্ড তা হলে তৃণমূলকে উৎখাত করতে যথেষ্ট নয় কেন? সারদা-অস্ত্রকে ধারাবাহিক এবং ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে দলকে নির্দেশ দেন অমিত। তাঁর কথায়, “সিঙ্গুরে দু’হাজার কৃষকের জমি গিয়েছিল। দিদি তখন অনশনে বসেছিলেন। এখন সারদা কাণ্ডে যে ১৭ লক্ষ রাজ্যবাসী ক্ষতিগ্রস্ত, দিদি আপনি অনশন, ধর্না ইত্যাদি করছেন না কেন?” এর পরেই অমিতের ব্যাখ্যা, “করছেন না, কারণ আপনার দল এবং চেলা-চামুণ্ডারা এতে লিপ্ত! কিন্তু আমাদের কোনও ভয় নেই। আমাদের কোনও কর্মকর্তা এতে জড়িত নন। সারদা হোক আর যা-ই হোক, আমরা ব্যবস্থা নেব!”
বৌবাজারের সভায় ওই কথা বলার আগে এ দিন বিজেপি-র রাজ্য কমিটির বৈঠকেও দলের সভাপতি প্রশ্ন তোলেন, সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পে জমি দিতে অনিচ্ছুক হাজারদুয়েক কৃষকের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। তা থেকেই রাজ্যে শাসক পরিবর্তন হয়ে গেল। তা হলে যে সারদা কেলেঙ্কারিতে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ ভুক্তভোগী, তা নিয়ে আন্দোলনের জোরে ফের ক্ষমতা পরিবর্তন করা যাবে না কেন? দলের ওই বৈঠকেই অমিত স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, সারদা প্রশ্নে শুধু তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদেরই আক্রমণ করলে চলবে না। সরাসরি আক্রমণ করতে হবে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। তাঁর ‘সৎ’ ভাবমূর্তি নিয়ে জনমানসে প্রশ্ন তুলে দেওয়াই হবে বিজেপি কর্মীদের কাজ। বিজেপি-র রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “সভাপতি বলেছেন, সিবিআইয়ের মুখ চেয়ে আমাদের বসে থাকার দরকার নেই। তদন্ত যেমন হওয়ার হবে। সারদার টাকা কোথায় গেল, সরাসরি তৃণমূল নেত্রীর কাছেই তার জবাব চেয়ে আমাদের পাড়ায় পাড়ায় সরব হতে হবে।”
বিজেপি সূত্রের খবর, শনিবার রাতে অমিতের সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ পেয়ে দলের রাজ্য পদাধিকারীরা তাঁকে অনুরোধ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার যেন সিবিআই তদন্তের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে। অমিত তাঁদের আশ্বস্ত করেন।
সভাপতির সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হয়েছেন বিজেপি কর্মীরা। চৌরঙ্গি বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী রীতেশ তিওয়ারির সমর্থনে বৌবাজার ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সামনে জনসভা ছিল অমিতের। তিনি সেখানে পৌঁছনোর আগেই বিজেপি কর্মীরা মমতা এবং সারদাকে জড়িয়ে অজস্র স্লোগান দেন। পরে ওই সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে সারদা কেলেঙ্কারিতে মমতার নাম শ্রোতাদের দিয়েই বলিয়ে নেন অমিত! মঞ্চ থেকে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘সারদার টাকা কে খেয়েছে?’ শ্রোতাদের মধ্য থেকে সমস্বরে জবাব আসে ‘মমতা’!
সারদার তদন্তে সিবিআইয়ের ফাঁস যখন চেপে বসছে, সেই সময়ে কেন্দ্রের শাসক দলের তরফে সুর চড়ানোর কৌশলে চাপ বেড়েছে তৃণমূলের উপরে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্যের শাসক দলের মধ্যে যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, একই দিনে দু’বার সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জবাব দেওয়ার চেষ্টার মধ্যেই তা অনেকটা স্পষ্ট। প্রকাশ্যে অবশ্যই তৃণমূল নেতৃত্ব দেখানোর চেষ্টা করছেন, বিজেপি-র মোকাবিলায় তাঁরা তৈরি। অমিতের জবাব দিতে আজ, সোমবার একই জায়গায় পাল্টা সভা করানো হচ্ছে তৃণমূল ‘যুবা’র সর্বভারতীয় সভাপতি তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে।
তৃণমূল ভবনে এ দিন দলের লোকসভার দলনেতা সুদীপবাবু প্রথমে বলেন, “সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজ করছে কি না, আমরা নজর রাখছি। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে সিবিআইকে ব্যবহার করা হলে এই তদন্তকারী সংস্থার ভাবমূর্তির পক্ষে তা ভাল হবে না। দরকার হলে আমরা দিল্লিতে প্রতিবাদ করব, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেও বক্তব্য পৌঁছে দেব।” তবে চৌরঙ্গি এবং বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল বেরোলে বিজেপি-র বেলুন এমনিই চুপসে যাবে, মন্তব্য সুদীপবাবুর। সুদীপবাবু যখন তৃণমূল ভবনে এ সব বলছেন, সেই সময়ে দফতরে উপস্থিত থাকলেও শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় কিন্তু সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেননি। এমনকী, হলদিবাড়ি পুরসভার ৬ কাউন্সিলরের (কংগ্রেসের ৫, সিপিএমের এক) তৃণমূলে যোগদানের আনুষ্ঠানিকতাও সেরেছেন সুদীপবাবু। মুকুলবাবুর হাতেই যে কাজ সম্পন্ন হওয়া এখন রুটিন!
পরে অমিতের বক্তব্য শুনে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার বলেন, “সিবিআইকে যে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি নিজেই তা বুঝিয়ে দিলেন!” সারদায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ১৭ লক্ষ নয় এবং তাঁরা সকলে মমতার জমানায় ক্ষতিগ্রস্ত নন বলেও পাল্টা সওয়াল করেছেন পার্থবাবু। তবে সঠিক প্রতারিতের সংখ্যা নিজেও বলেননি! তাঁর মন্তব্য, “এ সব ওঁরাই (অমিত) ভাল বলতে পারবেন!”
সারদা-অস্ত্রে নিজেদের মতো করে তৃণমূলকে বিঁধলেও অমিতের পাশে অবশ্য সরাসরি দাঁড়াতে চায়নি অন্য বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “তদন্ত হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। সঠিক তদন্ত হয়ে দোষীরা সাজা পাক, রাজ্যবাসী এটাই চান।” সিপিএমের সাংসদ মহম্মদ সেলিমেরও বক্তব্য, “এ রাজ্য থেকে মামলা হয়েছিল। হাইকোর্ট ঘুরে তা সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছিল। তদন্ত হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশেই। এতে বিজেপি-র কৃতিত্ব নেওয়ার কিছু নেই!” একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, “সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পরেও তৃণমূল কে ডি সিংহকে দিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে দরবার করেছে। কখনও মুকুল রায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গিয়েছেন।” অমিত নিজেই সিবিআইয়ের চার্জশিটে অভিযুক্ত ছিলেন এবং ‘রাজনৈতিক প্রভাবে’ ছাড় পেয়েছেন বলে অভিযোগ করে রাজ্যবাসীকে সতর্ক থাকতে বলেছেন সেলিম। বিজেপি নাছোড়! লোকসভার প্রচারে মোদী-মমতা দ্বৈরথের প্রসঙ্গ টেনে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “লোকসভা ভোটের আগে এক জন বলেছিলেন, কোমরে দড়ি পরাবেন। এখন উপনির্বাচনের আগে সিবিআই দড়ি পাকাচ্ছে! মানুষকে বলছি, সিবিআই কোমরে দড়ি পরানোর আগে আপনারাই কোমরে দড়ি বেঁধে ফেলে দিন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy