চোপড়ার দাসপাড়া এলাকায় এই চা বাগানের জমি বিক্রির চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ। — নিজস্ব চিত্র।
এ যেন আর এক ‘শাহজাহান-তন্ত্র’। তবে দক্ষিণের প্রত্যন্ত দ্বীপ সন্দেশখালি নয়, ঘটনাস্থল উত্তরের চোপড়া। বলা ভাল, তারও অন্দরে, লক্ষ্মীপুরে।
লক্ষ্মীপুরের আরুয়াগছে থাকেন জামালউদ্দিন (নাম পরিবর্তিত)। এখনও দুষ্কৃতীদের হাতে মার খাওয়ার কথা ভোলেননি। যে চা বাগানে কাজ করতেন, তা গড়ে ওঠার সময় জমি দিয়েছিল তাঁর পরিবার। মালিকপক্ষ বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, দেখভালের কাজে সেখানে যাতায়াত করেন জামালউদ্দিন। অভিযোগ, এখন সেই জমিতে নজর পড়েছে জেসিবি ওরফে তাজিমুল ইসলামের মতো দুষ্কৃতীদের। জমি কব্জা করতে গত ২৭ জুন রাস্তায় জামালউদ্দিনকে মারধর করা হয়েছে। জামালউদ্দিন নিরুপায় হয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কাছে। লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। “দেখছি,” মিলেছে এইটুকু জবাব। ভয়ে আছেন জামালউদ্দিন, কারণ, “ফের যদি ওরা এসে মারে!”
সন্দেশখালিতেও ভুক্তভোগীদের জমি দখল হয়ে যেত। প্রতিবাদ করলে জুটত মার। তৃণমূল নেতাদের দ্বারস্থ হলে, বিশেষ করে এলাকার মাথা শেখ শাহজাহানের কাছে গেলে মিলত শুধুই ‘দেখছি’। তার পরে সেই ‘মামলা’ চলে আসত তাদের হাতে, যারা এই সব অপরাধের মূলে এবং শাহজাহানের প্রধান শাগরেদ।
চোপড়ার ভুক্তভোগীরা সাম্প্রতিক সালিশিতে মারধরের ঘটনার প্রেক্ষিতে বলছেন, এই ঘটনা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। চোপড়ায় দুষ্কৃতীরা তার থেকে আরও বড় কাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন। যেমন, বালির অবৈধ কারবার, চা বাগানের জমি জবরদখল করে বিক্রি, আগ্নেয়াস্ত্র কেনাবেচা, সীমান্তে গরু পাচার, মাদক পাচারের চক্রকে সক্রিয় মদত। প্রশাসন-পুলিশ কিছু করে না? স্থানীয়দের ক্ষোভ বেরিয়ে আসে এই কথায়। তবে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে চান না।
স্থানীয় সূত্রের দাবি, বালির অবৈধ কারবার চলে হাপতিয়াগছ, চোপড়া এবং সোনাপুর এলাকায়। চোপড়ার দলুয়ায় ডক নদী এবং সোনাপুরে নলবাড়ি এবং চিতলঘাটা এলাকায় মহানন্দার পারে রয়েছে ‘অবৈধ’ খাদান। বালি তোলা হয় প্রতিদিন শতাধিক গাড়িতে। বালি যায় মালদহ থেকে বিহার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “রোজ যত ডাম্পার চলে, তাতে অনুমান করা যায়, দৈনিক অন্তত ২৫ লক্ষ টাকার বালি উঠছে।” প্রদেশ কংগ্রেসের সদস্য তথা চোপড়ার বাসিন্দা অশোক রায়ের দাবি, “বালির অবৈধ কারবারে কোটি কোটি টাকা রোজগার চলছে। পুলিশ-প্রশাসন জেনেবুঝেও চুপ। কারণ, টাকা যায় সব জায়গায়।” ব্লক ভূমি এবং ভূমি সংস্কার আধিকারিক সুবিমল চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, “সে ধরনের অভিযোগ নেই। বর্ষায় বালি তোলা বন্ধ। ঘাটের লিজ যাঁরা নেন, তাঁরা বৈধ ভাবে বালি তোলেন।” ইসলামপুর পুলিশ-জেলার সুপার জবি টমাসের দাবি, “অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের কিন্তু দাবি, বৈধ বলে প্রায় কিছু নেই জেসিবি-দের এলাকায়। চোপড়ায় ৫০টির বেশি ছোট-বড় চা বাগান রয়েছে। আরুয়াগছের মতো দাসপাড়ার কাছেও একটি চা বাগানের জমি কব্জা করা হয়েছে বলে অভিযোগ সেখানকার বাসিন্দা, শ্রমিক পরিবারের একাংশের। ভাগ ভাগ করে বিঘা প্রতি পাঁচ থেকে ১০ লক্ষ টাকা দরে জমি বিক্রি করছে একটি ‘সিন্ডিকেট’। তাতে জমি দখল করার লোক, জমির জন্য খরিদ্দার জোগাড় করার লোক এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের ‘সহাবস্থান’। সম্প্রতি পেয়ারিলাল চা বাগানের জায়গা দখল করতে গেলে সেই ‘সিন্ডিকেট’-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান বাগানের কর্মী আদিবাসীরা।
সিপিএমের উত্তর দিনাজপুর জেলা সম্পাদক আনোয়ারুল হকের দাবি, “বাগানে সমস্যা তৈরি করে মালিককে চাপ দিয়ে বাগান ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। পরে, গায়ের জোরে সে জমি দখল করে বা কর্তৃপক্ষের থেকে নামমাত্র দরে কিনে তৃণমূলের নেতারা লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি করছেন।” ব্লক ভূমি সংস্কার আধিকারিক সুবিমল চক্রবর্তী বলেন, “মালিকপক্ষ বাগান ছেড়ে চলে যাওয়া একটি জমি খাস করা হয়েছে। জরদখলকারীদের সরানো হয়েছে। তবে স্থানীয় স্তরে বাগানের জমি বিক্রির বিষয়টি আমাদের জানার কথা নয়। বাগানের কোনও জমি বিক্রির রেজিস্ট্রি হবে না।”
জামালউদ্দিনের অভিযোগ পেয়েছেন? এলাকার তৃণমূল নেতারা বলছেন, “দেখা হচ্ছে।” বিরোধীদের দাবি, বালি কিংবা চা বাগানের জমির অবৈধ কারবার চলে তৃণমূলের বিধায়ক হামিদুল রহমানের মদতে। কার্যত তাঁকেই ‘চোপড়ার শাহজাহান’ বলছেন তাঁরা। অভিযোগ উড়িয়ে হামিদুলের দবি, “ভিত্তিহীন কথা। রাজনীতি করতে এ সব বলা হচ্ছে।”
জামালউদ্দিনদের চোখ-মুখের আতঙ্ক অবশ্য তা বলে না।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy