—প্রতীকী ছবি।
জ্ঞানদাসুন্দরী প্রাথমিক বিদ্যালয়। নির্বাচন কমিশনের খাতায় বুথ নম্বর ১২৭। এই ভোট-কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী অরিন্দম বিশ্বাসের প্রাপ্তি ৮ এবং বিজেপির মনোজ কুমার বিশ্বাসের ৫২ ভোট। আর তৃণমূল কংগ্রেসের মুকুটমণি অধিকারীর বাক্সে ৯৭১ ভোট। শতাংশের হিসেবে দেখলে প্রদত্ত ভোটের ৯৩.৬৪%-ই শাসক দলের ঝুলিতে!
কুঞ্জবিহারী দাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রুম নম্বর ২। সেখানেও সিপিএম এবং বিজেপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট যথাক্রমে ১১ ও ৬৪। তৃণমূল প্রার্থীর ভোট ৫০৯। এই বুথে যত ভোট পড়েছে, তার ৮৫.৯৮%-ই শাসক দলের প্রতীকে!
রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের এই দুই বুথ নমুনা মাত্র। সদ্য উপনির্বাচন হয়ে যাওয়া চার বিধানসভা কেন্দ্রের নানা অঞ্চলেই এমন ছবি ছড়িয়ে আছে। বিরোধীরা যাকে বলে ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’! তবে লোকসভা নির্বাচনে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত চারটি বিধানসভা এলাকার বিভিন্ন বুথে যে ছবি ধরা পড়েছিল, তার সঙ্গে উপনির্বাচনের ‘মডেল’-এর কিছু ফারাক আছে। মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের ২৬৮ নম্বর বুথে সিপিএম প্রার্থী রাজীব মজুমদারের খাতায় শূন্য ভোট দেখা যাচ্ছে ঠিকই। তবে বিরোধীদের নামের পাশে এই ধরনের শূন্য, এক, দুই বা পাঁচ ভোট এ বার সার্বিক চিত্র নয়। বরং, বিরোধীরা পরের পর বুথে একই ‘ছকে’ ৪০, ৫০ বা ৭০ ভোট পেয়েছেন। শাসক দলের প্রার্থী পেয়েছেন সেখানে ৩০০, ৪০০ বা ৫০০ ভোট। এই ভাবেই তৈরি হয়েছে ‘ব্যবধান’।
বিরোধীদের দাবি, উপনির্বাচনের দিন সকালের দিকে বুথে বিশেষ বাধা ছিল না। পরে বিরোধীদের এজেন্টদের বুথ ছাড়তে হয়েছে এবং পরের অর্ধেই ‘খেলা হয়েছে’! শাসক দলের অবশ্য দাবি, লাগাতার পরাজয়ের ধাক্কায় বিরোধীরা অসার তত্ত্ব খাড়া করছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে পাওয়া তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, রানাঘাট দক্ষিণ কেন্দ্রে অন্তত ১৪টি ভোট-কেন্দ্র আছে, যেখানে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৮০%-এর উপরে। মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রে গত জুনের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের এগিয়ে থাকার ব্যবধান ছিল প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। তার মধ্যে ১৬ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়েছিল বিজেপি। জুলাইয়ে উপনির্বাচনে শুধু ১৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকেই তৃণমূলের ‘লিড’ ৩ হাজার ৫৭০। আর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল এগিয়ে ৭ হাজার ১৪৭ ভোটে। ওই কেন্দ্রেরই ১৪ এবং ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে শাসক দলের প্রার্থী এগিয়ে গিয়েছেন যথাক্রমে ১২ হাজার ৭০৪ ও ১২ হাজার ৯৭০ ভোটে। আরও গভীরে গেলে ৬৩ নম্বর বুথে বিজেপির কল্যাণ চৌবে যেখানে ১০০ এবং সিপিএমের রাজীব ২৮টি ভোট পেয়েছেন, তৃণমূলের সুপ্তি পাণ্ডে পেয়েছেন ৭১৬ ভোট। বুথ নম্বর ৭৫-এ বিজেপির ভোট ৬৭, সিপিএমের ৯ এবং তৃণমূলের ৪৭৬। একই কেন্দ্রের ১৪৫, ১৪৬, ১৪৭, ১৪৮ বা ১৬০ নম্বর বুথে ঢুকলে বিজেপি এবং সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট সব জায়গাতেই প্রায় একই। উল্টো দিকে তৃণমূলের ভোট ৩৪২, ৩৯২, ৩৬২, ৩৬৭, ৩৪৯। এক ঝলকে মনে হবে, বুথে বুথে ভোটের যেন প্রতিলিপি করে সংখ্যা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে!
বাগদা কেন্দ্রের ২৩৩, ২৩৫, ২৪০, ২৭৮ নম্বরের মতো বুথের পরিসংখ্যানকে হাতিয়ার করে ‘ভোট লুটে’র অভিযোগ করছে বিরোধীরা। এর মধ্যে ২৩৫ নম্বর বুথে তৃণমূলের মধুপর্ণা ঠাকুর পেয়েছেন ৮৪৪ ভোট। ফরওয়ার্ড ব্লকের গৌর বিশ্বাস সেখানে ৩০ এবং বিজেপির বিনয় বিশ্বাস ১০! একই ভাবে ২৩৩ নম্বর বুথে তৃণমূল ৬৭৮, ফ ব ৪৭ এবং বিজেপি ৫৫। আবার ২৪০ নম্বর বুথে তৃণমূল ২৮১, ফ ব ২ এবং বিজেপি ৩৪। একই ধরনের ভোট-চিত্র ধরা পড়ছে রায়গঞ্জের বেশ কিছু বুথ থেকেও। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কথায়, ‘‘লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জে বিজেপি পেয়েছিল ৯৩ হাজার ৪০২ ভোট। আর তৃণমূল কংগ্রেস ৪৬ হাজার ৬৬৩। এক মাস পরে উপনির্বাচনে বিজেপি হয়ে গেল ৩৬ হাজার ৪০২, তৃণমূল পৌঁছে গেল ৮৬ হাজার ৪৭৯-তে। সচিত্র পরিচয়পত্র বা অন্য কোনও পরিচয়পত্র ছাড়াই শুধু স্লিপ দেখিয়ে ভোট দিতে দেওয়া হয়েছে।’’
বিরোধী দলনেতার অভিযোগ, রানাঘাট দক্ষিণে ৭০ হাজার, বাগদায় ২০ হাজার এবং রায়গঞ্জে প্রায় ৫০ হাজার বৈধ ভোটারকে উপনির্বাচনে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। মানিকতলায় ‘লুট’ হয়েছে ৮টি ওয়ার্ডেই। ভোটদানে ‘বঞ্চিত’দের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পোর্টালও খুলেছেন শুভেন্দু। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনের অল্প দিনের মধ্যেই দিনহাটা আর গোসাবায় উপনির্বাচনে ফল উল্টে দিয়ে বিপুল ব্যবধানে জিতেছিল তৃণমূল। লোকসভা নির্বাচনের এক মাসের মধ্যে চার কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও তা-ই হয়েছে। শাসকের অপকর্মের ছবি যত বেরোয়, ভোট তত বাড়ে! এটাই ম্যাজিক!’’ আত্মসমীক্ষা করবেন জানিয়েও রায়গঞ্জের কংগ্রেস প্রার্থী ও উত্তর দিনাজপুর জেলা সভাপতি মোহিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘‘এই জয় (তৃণমূলের কাছে) বিক্রি হয়ে যাওয়া, শাসকের দলদাসে পরিণত হওয়া জেলা ও পুলিশ-প্রশাসনের জয়, ছাপ্পার জয়!’’
ভোটে কারচুপির অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের নেতা কুণাল ঘোষ অবশ্য পাল্টা বলছেন, ‘‘ভোট দিতে গিয়ে বাধা পেয়ে ফিরেছেন, এমন এক জনেরও ছবি কোনও বিজেপি নেতা বা সংবাদমাধ্যম দেখাতে পারেনি! লোকসভায় যাঁরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন হতাশ। তাঁদের এক অংশ উপনির্বাচনে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। আর কট্টর বিজেপি সমর্থকদের একাংশ হয়তো ভোট দিতে যাননি।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘মামলা করে মানিকতলায় ভোট আটকে রেখেছিল কল্যাণ চৌবে। আবার উপনির্বাচন ঘোষণা হতেই প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল! তাতে মানুষ আরও বিরক্ত হয়ে ওদের (বিজেপি) প্রত্যাখ্যান করেছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy