পদ্ধতি কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক দেশ, এক ভোট। এটা বিজেপির পুরনো লক্ষ্য। এ বার কি সেটাই কার্যকর করতে চায় মোদী সরকার? ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে কি গোটা দেশে সমস্ত রাজ্যের বিধানসভা ভোট হবে? না কি লোকসভা ভোটও মাস কয়েক এগিয়ে আনা হবে? তাতে মাত্র দু’বছর হওয়া পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের ভবিষ্যৎ কী? তবে কি সরকার ফেলে দিয়ে আবার ভোটের মুখোমুখি হতে হবে? এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ।
বৃহস্পতিবারই কেন্দ্রের তরফে ঘোষণা করা হয়, আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ দিনের বিশেষ অধিবেশন হবে সংসদের। তখনই মনে করা হয়েছিল বিশেষ কোনও পরিকল্পনা নিয়েই এই উদ্যোগ। এর পরে শুক্রবার সকাল থেকেই দিল্লিতে শুরু হয়ে যায় নতুন তৎপরতা। ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকরের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে মোদী সরকার। সেই কমিটির শীর্ষে বসানো হয় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে। ইতিমধ্যেই কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা। সরকারি ভাবে নির্বাচন কমিশনকেও এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল। কারণ, একসঙ্গে গোটা দেশে জোড়া ভোট করতে হলে অনেক বেশি ইভিএম, ভিভিপ্যাট দরকার। ফলে আচমকা নয়, সময় নিয়েই এই পথে এগিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
দেশে এমন নীতি তৈরির কথা বিজেপি ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহারেই বলেছিল। ভোটে জেতার পরে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় লালকেল্লা থেকে এই নীতি কার্যকরের কথাও বলেছিলেন মোদী। এর পরে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবসের অনুষ্ঠানে মোদী আবার বিষয়টির উত্থাপন করেন। সেই সময়ে তিনি বলেছিলেন, “এটি এখন সময়ের দাবি।” এই বিষয়ে প্রধান যুক্তি দেওয়া হয় খরচ কমানো। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে সরকারের খরচ হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। রাজনৈতিক দলগুলির খরচ ধরলে সব মিলিয়ে পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ছাড়া প্রতিটি রাজ্যে বিধানসভা ভোটের জন্য বিপুল পরিমাণে খরচ হয়। লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে গোটা দেশের বিধানসভা ভোট করতে পারলে সেই খরচ অনেকটাই কমে যাবে। এক খরচে সব রাজ্যের ভোট হয়ে যাবে।
‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির পক্ষে আরও একটা যুক্তি হল, আলাদা আলাদা নির্বাচন মানে প্রতি ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যায় জনবল অর্থাৎ সরকারি কর্মী ও অফিসারদের নিয়োগ করতে হয়। ফলে সরকারি কাজ ব্যাহত হয়। এ ছাড়া দফায় দফায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি প্রয়োগের ফলেও সরকারি কাজ ব্যাহত হয়। একসঙ্গে ভোট হলে পাঁচ বছরে এক বার মাস দেড়েকের জন্য আদর্শ আচরণ বিধি চালু থাকবে। তাতে উন্নয়ন থমকে থাকবে না।
এমন উদ্যোগ নিয়ে অতীতেও আলোচনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় আইন কমিশন ইন্দিরা গান্ধী থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতি নিয়ে আলোচনা করেছে। আইন কমিশন ২০১৮ সালের ৩০ অগস্ট যে রিপোর্ট সরকারকে জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে— বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী একসঙ্গে ভোট করা সম্ভব নয়। এ জন্য জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধন ছাড়াও সংবিধানের অন্তত পাঁচটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তন প্রয়োজন।
যে যে ধারা বা অনুচ্ছেদের পরিবর্তন প্রয়োজন তার মধ্যে সবার প্রথমে রয়েছে ৮৩ (২)। এখানে বলা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সময়সীমা পাঁচ বছরের বেশি হতে পারে না। তবে প্রয়োজনে কমানো যায়। এ ছাড়াও অনুচ্ছেদ ৮৫ (২) (বি), ১৭২ (১), ১৭৪ (২) (বি) বদলাতে হবে। এগুলির সবই রাজ্যের সরকার নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ধারা। পরিবর্তন চাই রাজ্যে সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ৩৫৬ ধারাতেও। এই পরিবর্তনের জন্য লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সংবিধান সংশোধনী বিলে সমর্থন দরকার। সেই সঙ্গে চাই সব রাজ্য সরকার এবং রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য। তার পরেও দেশের কমপক্ষে অর্ধেক রাজ্যের বিধানসভায় তা পাশ করিয়ে নিতে হবে। দেশের ৩০টি বিধানসভার মধ্যে ১৫টির সমর্থন চাই। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন দেশের ১০ রাজ্যে। এ ছাড়া বিজেপির জোট সঙ্গী ৫টি রাজ্যে ক্ষমতায়। ফলে বিজেপির পক্ষে এই পরিবর্তন খুব সহজ যেমন নয়, তেমন অম্ভবও নয়।
তবে ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতিতে কিছু সমস্যাও রয়েছে।এক বার গোটা দেশে একসঙ্গে ভোট করালেই যে পরের ৫ বছরে কেন্দ্র বা কোনও রাজ্যের সরকার মাঝ পথে পড়ে যাবে না তা নিশ্চিত করা যাবে কী ভাবে? কোথাও ৩৫৬ ধারা জারির প্রয়োজন হবে না, এমনটা কি জোর দিয়ে বলা যায়? তেমনটা হলে আবার আলাদা আলাদা সময়ে নির্বাচনের পরম্পরা ফিরে আসবে। দেশে ১৯৫১ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত দু’টি ভোট একসঙ্গেই হয়েছে। কিন্তু জওহরলাল নেহরু ১৯৫৯ সালে কেরলের সরকার ফেলে দিলে একসঙ্গে ভোটের নীতি আর বজায় থাকেনি। এর পরে অন্যান্য রাজ্যেও এমন সব হতে থাকায় ভোট হয়েছে আলাদা আলাদা সময়ে। এখন তাই নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা পাল্টে অকাল নির্বাচনের রাস্তাও বন্ধ করতে হবে।
সে ক্ষেত্রে এমন আইনও তৈরি করতে হবে যাতে কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই ক্ষেত্রেই সরকার পড়ে গেলে বিকল্প সরকার গঠনের চেষ্টা করা যায়। যদি তা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শাসন কায়েম করাই যায়। কিন্তু বিধানসভা চালু থাকবে। পাঁচ বছর পরেই বিধানসভার ভোট হবে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারে যে হেতু রাষ্ট্রপতি শাসনের সুযোগ নেই সেখানে একটা পথ খোলা থাকবে। কোনও সরকার সংখ্যালঘু হয়ে গেলে বিকল্প সরকার গঠন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy