কোনও রকম নিয়মের তোয়াক্কা না করেই শুক্রবার বাজে কদমতলা ঘাটে ভিড় পুণ্যার্থীদের। ছবি: সুমন বল্লভ
দু’টি ঘটনা আলাদা। ব্যবধান তিন বছরের। তবে ঘটেছিল একই মাস, জুনে। এ বার ছটপুজোকে কেন্দ্র করে মিলে গেল সেই দুই সময়সীমা। যার ফল, রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো-বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত হল গঙ্গা দূষণের পর্বও।
কী ভাবে? ঘটনাক্রম বলছে, ২০১৪ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন ও গঙ্গা পুনরুজ্জীবন মন্ত্রক ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প ঘোষণা করেছিল। বলা হয়েছিল, ২০ হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গার দূষণ রোধ, তার সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনের কাজ করা হবে। এর তিন বছর পরে, ২০১৭ সালে সম্পূর্ণ পৃথক একটি ঘটনায়, একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্র সরোবরের পরিবেশের উপরে ছটপুজোর প্রভাব নিয়ে আট জনের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি র্যাপিড ‘এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট স্টাডি রিপোর্ট’ (ইআইএ) তৈরি করেছিল। সেই বছরেরই জুনে প্রায় দেড়শো পৃষ্ঠার চূড়ান্ত রিপোর্টটি বই আকারে প্রকাশ করে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। সেখানে বলা হয়— ছটপুজোর জন্য রবীন্দ্র সরোবরের পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার কারণে সেখানে পুজো না করার জন্য পুণ্যার্থীদের সচেতন করা হোক।
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু পরের লাইনেই যে সুপারিশ করা হয়েছিল, তা ঘিরেই সাম্প্রতিক ছটপুজো-বিতর্ক আলাদা মাত্রা পেয়েছে। যেখানে বলা হয়েছিল, রবীন্দ্র সরোবরের পরিবর্তে গঙ্গায় পুজো করতে পারেন পুণ্যার্থীরা! অনেকে মনে করছেন, এই সূত্রেই ‘নমামি গঙ্গে’ ও ছটপুজো এক সূত্রে বাঁধা পড়ে গিয়েছে। এক নদী বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘গঙ্গা-দূষণ জেনেও কিসের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি সেখানে ছটপুজোর সুপারিশ করল, তা পরিষ্কার নয়।’’
বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে গঙ্গায় ছটপুজোর সুপারিশ। ছবি: সুমন বল্লভ
বইটির ‘চিফ এডিটর’ ছিলেন পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র, যিনি এক জন নদী-বিশেষজ্ঞও। এ বিষয়ে কল্যাণবাবু বলেন, ‘‘পর্ষদ রিপোর্টটি শুধু প্রকাশ করেছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের দায়িত্ব পর্ষদের নয়। এর কারণ কমিটিই বলতে পারবে।’’
কমিটির অবশ্য বক্তব্য, জলের স্রোত না থাকায় রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো হলে সেখানে দূষিত পদার্থ জমে থাকে। কিন্তু গঙ্গার স্রোতের কারণে তা ভেসে চলে যায়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান তথা পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র বোর্ডের চেয়ারম্যান অশোককান্তি সান্যাল বলেন, ‘‘কোনও এলাকায় পুকুর না থাকলে অন্যত্র যেখানে পুকুর-জলাশয় রয়েছে, সেখানে ছটপুজো করার পাশাপাশি গঙ্গাকেও দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছিল।’’ কিন্তু এর ফলে কি গঙ্গা দূষিত হয় না? অশোকবাবুর কথায়, ‘‘গঙ্গার বিশালতার কারণে দূষণ হলেও স্রোতে ওই ফুল-বর্জ্য অন্যত্র চলে যায়।’’
যদিও নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার জানাচ্ছেন, বর্ষার পরবর্তী সময়ে গঙ্গায় জল কমতে শুরু করে। তখন জলে মোট কলিফর্ম ও ফিকাল কলিফর্ম ব্যাক্টিরিয়ার সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে গঙ্গায় ছটপুজো হলে কঠিন বর্জ্যের দূষণের আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া স্রোতে সব ভেসে গেলে তো বিভিন্ন পুর এলাকার যে পরিমাণ মলমূত্র, তরল ও কঠিন নিকাশি বর্জ্য প্রতিনিয়ত গঙ্গায় পড়ছে, সবই ভেসে চলে যেত! তাঁর কথায়, “যদি ধরেও নেওয়া যায়, গঙ্গার এক জায়গায় ফেলা পুজো-সামগ্রী অন্যত্র ভেসে গেল, তখন তো এক জায়গার পরিবর্তে অন্যত্র গঙ্গা দূষণ হবে। তার পরিবর্তে দূষণ রোধের উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে পুর এলাকার পুকুরগুলিতে ছটপুজো করা যায়।’’
ভাসানের কারণে গঙ্গা দূষণ নিয়ে ২০১৭ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করেছিলেন কেন্দ্রীয় জ্বালানি গবেষণা সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অম্বরনাথ সেনগুপ্ত। যার পরিপ্রেক্ষিতে গঙ্গায় ভাসান দেওয়া নিয়ে রাজ্যকে নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। অম্বরনাথবাবু বলেন, ‘‘ছটপুজোর কারণে গঙ্গা দূষণের বিষয়টিও ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে গঙ্গায় ভাসানের পাশাপাশি ছটপুজোও বন্ধ করা প্রয়োজন। না হলে তাকে বাঁচানো যাবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy