ঠাকুমা খুনে অভিযুক্ত ইন্দ্রনীল রায়। নিজস্ব চিত্র।
ঠাকুমাকে খুরপি দিয়ে খুন করল একমাত্র নাতি! ওই একই অস্ত্র দিয়ে বাবা-মাকেও আক্রমণ করল সে। পুলিশ-দমকল-প্রতিবেশীরা যখন এলেন, গোটাটার ফেসবুক লাইভ করল বছর তেইশের ওই যুবক! সোমবার সকালের এই ঘটনায় ইন্দ্রনীল রায় নামে ওই যুবককে গ্রেফতার করেছে হুগলির চুঁচুড়া থানার পুলিশ।
কেন সে ঠাকুমাকে খুন করল? বাবা-মাকেই বা খুরপি দিয়ে জখম করলকেন? গ্রেফতারের পর এ প্রশ্ন বছর তেইশের ইন্দ্রনীলকে বার বার করেও কোনও সন্তোষজনক জবাব পাননি তদন্তকারীরা। অসংলগ্ন নানা জবাব দিয়েছে সে। কখনও বলেছে, ‘‘আমি তো মারিনি।’’ কখনও বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেছে, ‘‘কতগুলো লোক ঘুরছিল বাড়ির বাইরে। ওরাই মেরেছে।’’ এমন সব জবাবই দিয়েছে নির্লিপ্ত ইন্দ্রনীল। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা, মানসিক অবসাদেই ভুগছে শ্রীরামপুর কলেজের প্রাক্তন ওই ছাত্র।
ব্যান্ডেলের কেওটা শিবতলা এলাকায় রেল-কর্মচারী বিশ্বজিৎ রায়ের দোতলা বাড়ি। তাঁর একমাত্র ছেলে ইন্দ্রনীল ঠাকুমা আরতি রায়ের (৮৩) সঙ্গেই দোতলায় থাকত। অন্য দিকে, স্ত্রী তাপসীকে নিয়ে একতলায় থাকতেন বিশ্বজিৎ। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, সোমবার ভোরের দিকে দোতলার ঘর থেকে ধুপধাপ আওয়াজ এবং চিৎকার শুনতে পান বিশ্বজিৎবাবু। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যান। দোতলায় উঠতেই তাঁর দিকে একটি ধারালো খুরপি নিয়ে এগিয়ে আসে ইন্দ্রনীল। সজোরে সেই খুরপি সে বসিয়ে দেয় বাবার বাঁ-হাতে। বিশ্বজিৎবাবুর চিৎকার শুনে তাঁর স্ত্রী তাপসীদেবী উপরে ওঠেন। তাঁকেও খুরপি দিয়ে আক্রমণ করে ছেলে।
পাশের বাড়ি থেকে আসা এমন চিৎকার শুনে প্রতিবেশীদের কয়েক জন চলে আসেন রায় বাড়িতে। তাপসীদেবী দরজাও খুলে দেন। এর পর বিশ্বজিৎবাবুকে একতলায় নামিয়ে এক প্রতিবেশী দোতলার সিঁড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে দেন। খবর দেওয়া হয় চুঁচুড়া থানায়। তখনও তাঁরা আরতিদেবীর খবর জানতেন না। অভিযোগ, খবর পেয়ে পুলিশ আসতে দেরি করে। ইতিমধ্যে দোতলা থেকে ছাদে উঠে যায় ইন্দ্রনীল। পাড়া-প্রতিবেশীরা তত ক্ষণে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন রায়-বাড়ির সামনে।
সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ পুলিশ এসে দেখে, ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইন্দ্রনীল। নীচ থেকে পুলিশ কর্মীরা তাকে নেমে আসতে বলায় কোনও কাজ হয়নি। এর পর খবর দেওয়া হয় দমকলে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারাও এসে পড়ে। ইতিমধ্যে পুলিশের নির্দেশে দোতলার সিঁড়ির তালা খুলে দেওয়া হয়। নীচে নেমে আসে ইন্দ্রনীল। একতলায় এসে সে মোবাইল বার করে গ্রিলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ এবং প্রতিবেশীদের তাক করে ফেসবুক লাইভ করতে থাকে। সঙ্গে চলতে থাকে অসংলগ্ন কথাবার্তা। যাঁরা সেই সময় ওর ফেসবুক লাইভ দেখছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও কথা চালাচালি করছিল ইন্দ্রনীল। তাকে লিখতে দেখা যায়, ‘‘এই নরক থেকে আমাকে উদ্ধার করো।’’
এর পরেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। উপরে উঠে পুলিশ দেখে, আরতিদেবীর রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে ঘরে। বিশ্বজিৎবাবু-তাপসীদেবীর সঙ্গে সেই দেহও হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসকেরা জানান, আরতীদেবী মারা গিয়েছেন। আর ছেলের খুরপির কোপে বাঁ হাত কেটে এবং ভেঙে গিয়েছে বিশ্বজিৎবাবুর। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা, ঠাকুমাকে খুন করেছে ইন্দ্রনীলই। বিশ্বজিৎবাবুও পুলিশকে তেমনটাই জানিয়েছেন।
ডানলপের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পর ব্যান্ডেল ডন বস্কোয় পড়াশোনা করে ইন্দ্রনীল। তার পর শ্রীরামপুর কলেজ। পড়াশোনায় বেশ ভালই ছিল সে। কলেজ শেষে সরকারি চাকরির পরীক্ষাও দিচ্ছিল। রবিবার দমদমে এসেছিল একটি পরীক্ষা দিতে। পুলিশি জেরায় সে জানিয়েছে, পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় তাকে এক জন লস্যি খাওয়ায়। রাতে পারিবারিক পিকনিকও ছিল পাড়ায়। সেই পিকনিক থেকে বাবা বিশ্বজিৎবাবু সাইকেলে করে বাড়ি ফেরেন। মা তাপসীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরে ইন্দ্রনীল। তার পর রাতে ঠাকুমার পাশের ঘরে শুতে যায়।
আরও পড়ুন: ‘শয়তান ঢুকেছে’ সন্দেশখালিতে, আতঙ্কে পালাচ্ছে মানুষ
ইন্দ্রনীলের করা ফেসবুক লাইভের ভিডিয়ো
তবে ঠাকুমাকে কেন রাতে খুন করল ইন্দ্রনীল, সে ব্যাপারে এখনও স্পষ্ট করে কিছুই জানতে পারেনি পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে তাদের ধারণা, দীর্ঘ দিন ধরেই মাদকাসক্ত ইন্দ্রনীল। চাকরি না পাওয়ার কারণে অবসাদগ্রস্তও ছিল। সেই কারণেই এই খুন কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি দমদমে লস্যিতে কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল কি না তা-ও দেখা হচ্ছে তদন্তে। এমনকি, টাকাপয়সার কারণেই কি সে ঠাকুমাকে খুন করল, সেটাও দেখছেন তদন্তকারীরা।
মনোরোগ চিকিৎসক কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত, কোনও ব্যক্তির ‘অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজর্ডার’ থাকলে তাঁর পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব। যদিও এই ডিজর্ডার এক দিনে হয় না। কেদারবাবুর কথায়, ‘‘খুব ছোট থেকেই এই ডিজর্ডারটা থাকে বাচ্চাদের ভিতরে। দেখবেন, এই বাচ্চারা ভীষণ ছটফটে হয়। বাবা-মায়েরা বুঝতে পারেন না।’’ তিনি জানান, এর পর বাচ্চার অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজর্ডার দেখা দেয়। দেখা দেয় ব্যবহার সংক্রান্ত সমস্যাও। পাশে থাকা কুকুর-বিড়ালকে ঢিল ছুড়ে মারা, দেশলাই হাতের কাছে পেলেই কিছুতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, সামান্য নেশা করা, একটু আধটু চুরি করা— এই সমস্যার মধ্যেই পড়ে। বয়স যখন ১৮ পেরোয়, তখনই তার কনডাক্ট ডিজর্ডার দেখা দেয় বলে মত কেদারবাবুর। ইন্দ্রনীলের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যাই হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজর্ডারই হয়েছে। তবে এর খুব ভাল চিকিৎসা রয়েছে। যত ছোট বয়সে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে বাবা-মায়েরা নিয়ে যাবেন, তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে বাচ্চা। তবে বাবা-মায়েদের বোঝাটাও খুব জরুরি।’’
আরও পড়ুন: দলীয় কর্মীদের খুনের প্রতিবাদে বসিরহাট বন্ধে দফায় দফায় রেল, রাস্তা অবরোধ বিজেপির
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy