গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রং করা ছিমছাম পাকা বাড়ি। শনিবার পর্যন্ত বাড়িটিকে এক কথায় বলা যেত ‘সুন্দর’। রবিবার সকালের পর অবশ্য সেটা আর বাড়ি নেই। ধ্বংসাবশেষ! দেওয়াল খসে গিয়েছে। উড়ে গিয়েছে জানালার কাচ। ঘরের খাট, আলমারি, চেয়ার-টেবিল— সব ভেঙেচুরে ছড়িয়ে গিয়েছে যত্রতত্র। পাশের বাড়ির অবস্থা আরও করুণ। রান্নাঘরে হাড়ি-বাসন পর্যন্ত বেঁকে একসা। কী হল? কী ভাবে হল? ভূমিকম্প না কি? এ সব বুঝতে ওই বাড়িগুলির বাসিন্দাদের বেশ কিছুটা সময় লেগেছে। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে তাঁরা বলছেন ‘‘এ কেরামতের কাণ্ড।’’ যে কাণ্ডে রবিবার সকালে কেঁপে ওঠে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরের বারাসত শহরও। যে বিস্ফোরণের তীব্রতায় কারও দেহাংশ উড়ে গিয়ে পড়েছে পাশের বাড়ির ছাদে। যে বিস্ফোরণের অভিঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে সাতটি শরীর। কিন্তু কে এই কেরামত?
তিনি কেরামত আলি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তিনি স্থানীয়দের বাধা, বারণ ধর্তব্যে আনতেন না। নিজের মতো করে কারখানা খুলে ‘বাজি’ বানাতেন। রবিবার সকালে তাঁর অবৈধ কারখানায় বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত সাত জন। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে প্রতিবেশীদের বাড়িঘরের। অন্তত চারটি বাড়ি ভেঙেছে। আহত হয়েছেন বেশ কয়েক জন। এই কেরামতকে ‘তৃণমূলের লোক’ বলে দাবি করছে আইএসএফ। শাসকদলের অবশ্য দাবি, এই ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনই সম্পর্ক নেই। তারা এই গোটা কাণ্ডের দায় চাপিয়েছে আইএসএফের উপর। আরও স্পষ্ট করে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী রথীন রায় আইএসএফ নেতা রমজান আলির নাম নিয়েছেন। এ ছাড়া উঠে আসছে আজিবর রহমান নামে এক জনের নাম। বস্তুত, তাঁর বাড়ির গুদাম থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর নিষিদ্ধ বাজি। এলাকাবাসীর দাবি, তিনি তৃণমূল নেতা। ঘটনার পর থেকে অবশ্য খোঁজ মেলেন এই আজিবরের।
পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, দক্ষিণ ২৪ পরগনের বজবজের পর উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুর। আবারও বড় প্রাণঘাতি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল রাজ্যে। এই তিন জায়গার বিস্ফোরণস্থল বাজি কারখানা। তিন জায়গারই স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেছেন, ওই কারখানাগুলি বেআইনি তো বটেই, পাশাপাশি সেখানে আতসবাজির আড়ালে বিস্ফোরকও বানানো হত। যদিও তা তদন্তসাপেক্ষ। তবে ‘সারা বাংলা আতসবাজি ব্যবসায়ী সমিতি’র নেতা বাবলা রায়ও দত্তপুকুরের বিস্ফোরণস্থল ঘুরে বলছেন, ‘‘পটাশিয়াম ক্লোরাইড দিয়ে কোনও আতসবাজি তৈরি হয় না। ওখানে বিস্ফোরকই তৈরি হত।’’
কিন্তু এই গোটা কাণ্ডের মূল কে বা কারা? এলাকাবাসী ভিন্ন ভিন্ন নাম বলছেন। তাঁদের মধ্যে গোটা কয়েক নাম বারবার উঠছে। সবার আগে আসছে কেরামতের কথা।
কেরামতের কেরামতির কথা বলতে গিয়ে এলাকাবাসী ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। অভিযোগ, নিষিদ্ধ বাজির কারবার করতে গিয়ে একাধিক বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন কেরামত। কিন্তু ছাড়া পেয়ে আবার মন দিয়েছেন ‘বাজি’ তৈরিতে। গত মে মাসে এগরাকাণ্ডের পর যখন রাজ্যজুড়ে বেআইনি বাজি কারখানাগুলোতে অভিযান চালায় পুলিশ, তখনও কেরামত পাকড়াও হন বলে কারও কারও দাবি। কিন্তু প্রতি বার কেরামত ফিরে আসেন এবং প্রতি বার ওই বাজি ব্যবসা পেতে বসেন তিনি। পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় ব্যবসা করতেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘ওদের সব গোপন বোঝাপড়া আছে। পুলিশ তো ওদের কাছ থেকে টাকা খায়।’’
রবিবারের বিস্ফোরণে কেরামতের ছেলে রবিউল আলিও প্রাণ হারিয়েছেন। কেরামত কি বিস্ফোরণের সময় কারখানাতেই ছিলেন? তিনিও কি মৃত (যেমন বলছেন অনেকেই)? মৃতদের মধ্যে আরও যাঁদের চিহ্নিত করা গিয়েছে, তাঁদের নাম সামসুল আলি, জাহিদ আলি। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সামসুলের জমিতে কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। কেরামতই সেই কারখানা চালাতেন। রবিউল ওই কারখানায় কাজ করতেন।
দত্তপুকুর বিস্ফোরণকাণ্ডে ‘শাসক-যোগের’ দাবি করেছেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ। কিন্তু তাঁরা যখন কেরামতের সঙ্গে ‘স্থানীয় তৃণমূল নেতা’ আজিবরের নাম তুলছেন, তখন পাল্টা নওশাদের দলের নেতাদের জড়াচ্ছে শাসকদল। রাজ্যের মন্ত্রী রথীন বলছেন, রমজান আলির কথা। ঘটনাস্থল ঘুরে তিনি বলেন, ‘‘এই বুথে আইএসএফ জিতেছে। স্থানীয় আইএসএফ নেতা রমজান আলি রয়েছেন এর (বিস্ফোরণ) পিছনে। আমরা জানতাম না। পুলিশও জানত না।’’ পাল্টা নওশাদের চ্যালেঞ্জ, এক জন আইএসএফ নেতা বা কর্মীও যদি এই বিস্ফোরণে যুক্ত থাকেন বলে প্রমাণিত হয়, তিনি নিজে অভিযুক্তকে নিয়ে পুলিশের কাছে যাবেন। তাঁর কঠিন শাস্তির দাবি করবেন।
রবিবারের দত্তপুকুরে
বিকট শব্দের সঙ্গে চারপাশে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। তার মাঝেই ছাদের টালি ভেঙে কী যেন একটা মাটিতে পড়ল! একেবারে গা ঘেঁষে নরম একটা কিছু! প্রথমে খেয়াল করেন আরিফার শাশুড়ি। কাছে যেতেই বুক ধড়ফড় করে ওঠে বৃদ্ধার। এ যে একটা আস্ত হাত! প্রথমে ভেবেছিলেন, নির্ঘাত কোনও হনুমানের। পুত্রবধূ আরিফাকে ডাকেন। দু’জনে কাছে গিয়ে দেখেন, হনুমানের নয়, মানুষের হাত! রবিবার বিকেলে যখন ওই কখা বলেন আরিফা, কেঁপে ওঠে তাঁর শরীর। চোখেমুখে আতঙ্ক।
এলাকাবাসীরা বার বার বারণ করেছিলেন। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তবু শোনেননি সামসুল হক। তাঁর জমিতেই দিনের পর দিন রমরমিয়ে চলেছে বাজি তৈরির কাজ। সারা দিন খেটেখুটে এসে তিনি নিজেও বসে পড়তেন বাজি বানাতে। কারও বাধা কানে তুলতেন না। এমনটাই দাবি মৃত সামসুলের ভাইপো মফিজুল ইসলামের।
এই সামসুলের বাড়ি লাগোয়া জমিতে দিনের বেলায় চলত বাজি তৈরি। আর দু’টি ঘরে চলত বাজি প্যাকেজিংয়ের কাজ। মফিজুল জানান, কেরামত আলিকে বাজি কারখানা তৈরির জন্য এই জমি ভাড়া দিয়েছিলেন সামসুল। কেরামতের বাড়ি পাশের গ্রামে। বিস্ফোরণে তাঁর ছেলেরও মৃত্যু হয়েছে। মফিজুলের এ-ও দাবি, স্থানীয়দের আপত্তি উড়িয়েই কেরামতকে জমি ভাড়া দিয়েছিলেন সামসুল। তাঁর কথায়, ‘‘দীর্ঘদিন মানা করা হচ্ছিল। ওঁরা শুনতেন না।’’ বাড়তি রোজগারের আশায় কাকা এই কাজ করেছেন বলে জানান তিনি।
পেশায় রাজমিস্ত্রি মফিজুদ্দিন। দিন ১৫ আগে তাঁর নতুন বাড়িতে ঢুকেছে পরিবার। রবিবার সকালে সেই বাড়ির অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেছেন মফিজুদ্দিনের স্ত্রী। ঘরের দেওয়ালে ফাটলে ধরেছে। চিড় ধরেছে জায়গায়-জায়গায়। আসবাবপত্র, এমনকি খাট পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছে। মফিজুলের স্ত্রী কাঁদো কাঁদো মুখে প্রশ্ন করেন, ‘‘কার কাণ্ড কিচ্ছু জানি না। কিন্তু অন্যের কারণে আমাদের কেন এই ক্ষতি হল! ক্ষতিপূরণ দেবে কে?’’
বিস্ফোরণস্থল থেকে যে রাস্তা গিয়েছে, তার চার পাশে বাজি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুল হকের কথায়, ‘‘পুলিশ সব জানত। সব জানে। পয়সা খাচ্ছে। নেতারাও পয়সা খাচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ফাঁড়িতে লিখিত অভিযোগ করেছিলাম আমরা। কাজ হয়নি। এর আগেও বেরানারায়ণপুকুরে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছিল। এ বার মোচপোলে।’’
আরিফা আঙুল তুলেছেন কারখানার কর্মীদের দিকে। তিনি বলেন, ‘‘মোচপোলের বেআইনি বাজি কারখানায় এই কাজ অনেক দিন ধরে চলছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি। কারখানার প্রায় ১০০ জন কর্মী আমাদের ঘরে এসে হামলা করেছিলেন। হুমকি দিয়েছিলেন, কাজ না করতে দিলে প্রত্যেকের ঘরে রোজ ৫০০ টাকা করে দিয়ে আসতে হবে।’’
এআইএ তদন্তের দাবি
দত্তপুকুরে বিস্ফোরণে রাজনৈতিক চাপানউতরের তীব্র হচ্ছে। উঠেছে এনআইএ তদন্তের দাবি। সেই আর্জি নিয়ে রবিবারই বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিয়েছেন। অন্য দিকে, রবিবার রাতে উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও চলে যান ঘটনাস্থলে। আহতদের দেখতে বারাসত হাসপাতালে ঢোকার আগে তিনি জানান, একে নিছক দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে। শাহকে লেখা চিঠিতে সুকান্ত জানিয়েছেন, এই বিস্ফোরণকাণ্ডের নেপথ্যে জঙ্গি কার্যকলাপও থাকতে পারে। তাই সেই সব দিক মাথায় রেখে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য এনআইএ-এর হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়ার আর্জি জানান সুকান্ত।
বিস্ফোরণ এবং রাজনীতি
দত্তপকুরের ঘটনা নিয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী রাজ্য সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। তাঁর দাবি, সেই মে মাসে এগরার কাণ্ডের পর অবৈধ বাজি কারখানা নিয়ে কড়া পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতে কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, রবিবারের ঘটনা তারই প্রমাণ। শুভেন্দুর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কটাক্ষ, ‘‘কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়ছেন উনি।’’ এগরাকাণ্ডের কথা তুলে কুণালের অভিযোগ, কেন্দ্র ১০০ দিনের কাজের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় প্রান্তিক মানুষরা এমন সব কাজে যুক্ত হচ্ছেন। আর এগরাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ
রবিবার সকালে দত্তপুকুরের বাজি কারখানার বিস্ফোরণের ঘটনার পর সন্ধ্যায় রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালবীয় এবং কলকাতা পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে জরুরি তলব করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, ডিজি এবং কলকাতা পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে ঝাড়া দেড় ঘণ্টার বৈঠক হয় মুখ্যমন্ত্রীর। কী নিয়ে কথা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনও পক্ষের তরফেই কোনও বিবৃতি মেলেনি। তবে প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, দত্তপুকুরে কী ঘটেছে, পুলিশ এখনও পর্যন্ত তদন্ত কী কী পেয়েছে— এ বিষয়ে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীকে জমা দিয়েছেন ডিজি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy