বেআইনি বাজি উদ্ধারের ঘটনায় এলাকা থেকে মোট ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিজস্ব চিত্র।
এগরার রেশ কাটতে না কাটতেই কলকাতার অদূরে বজবজের একটি বাড়িতে বাজি বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, রবিবারের ওই বিস্ফোরণে এক বালিকা-সহ তিন মহিলা মারা গিয়েছেন। ওই ঘটনার পরেই ব্যাপক তল্লাশি ও ধরপাকড় শুরু করে পুলিশ। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি দোকান থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি বাজি ও বাজির মশলা বাজেয়াপ্ত করা হয়। রবিবার গভীর রাত পর্যন্ত গ্রেফতার হন ১৫ জন। সোমবার সকালে পুলিশ সূত্রে খবর, বেআইনি বাজি উদ্ধারের ঘটনায় এলাকা থেকে মোট ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার খাদিকুল গ্রামের বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৬ মে। মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ৯ জনের। তার পাঁচ দিনের মাথায়, ২১ মে বজবজে বিস্ফোরণ ঘটল। পর পর দু’জায়গায় বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। এগরার মতো বজবজের ঘটনার তদন্তও সিআইডি করছে। সোমবার বজবজের দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে ফরেন্সিক দল। দিনভর চলল বেআইনি বাজির খোঁজে পুলিশি অভিযানও।
বজবজের যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেখান থেকে গাড়ি-গাড়ি বাজি, বাজির মশলা উদ্ধারের পরে পুলিশের একাংশের বক্তব্য, পুরো এলাকা কার্যত বারুদের স্তূপের উপর বসে রয়েছে। তার পরেও পুলিশ কেন এত দিন চুপচাপ ছিল, সেই প্রশ্নও জোরদার হয়েছে। কিন্তু বিস্ফোরণের পর থেকে পুলিশের তল্লাশি অভিযান নিয়ে ‘ক্ষুব্ধ’ স্থানীয় বাজি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা কলকাতার রাজপথে বিক্ষোভ দেখানোরও হুঁশিয়ারি দেন। এই পরিস্থিতিতে আতশবাজি নিয়ে ক্লাস্টার গড়তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়েছে নবান্ন।
বিপুল বাজি উদ্ধার
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের মহেশতলার চিংড়িপোতা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্ত চলাকালীন ৩৭ হাজার কেজিরও বেশি বাজি উদ্ধার করেছে ডায়মন্ড হারবার জেলা পুলিশ। ডিএসপি (ইন্ডাস্ট্রিয়াল) নিরুপম ঘোষের নেতৃত্বে রবিবার রাত থেকেই মহেশতলা এবং বজবজ থানার পুলিশের যৌথ উদ্যোগে সমগ্র বাজিপাড়া জুড়ে ব্যাপক তল্লাশি চলেছে। পুলিশি অভিযানে উদ্ধার হয়েছে বহু নিষিদ্ধ বাজি। বজবজ এবং তৎসংলগ্ন এলাকার বেশ কয়েকটি বন্ধ দোকানের দরজা ভেঙে পুলিশ নিষিদ্ধ বাজি উদ্ধার করেছে। পুলিশ সূত্রে খবর, বেআইনি বাজি উদ্ধারের ঘটনায় ৫টি আলাদা আলাদা মামলা রুজু করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন ৯ মহিলা-সহ মোট ৩৪ জন। সোমবার তাঁদের আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয়। তাঁদের মধ্যে বেছু মণ্ডল নামে এক জনকে বিচারক ৩০ মে পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবী শেখ আব্দুস সালাম।
ঘটনাস্থলে সিআইডি ও ফরেন্সিক
বজবজে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণকাণ্ডের তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। সোমবার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন সিআইডির আধিকারিকেরা। স্থানীয়দের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন। কথা বলেছেন পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গেও। সিআইডির পাশাপাশি ঘটনাস্থলে গিয়েছেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরাও। ঘটনাস্থল থেকে তাঁরা নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
বাজির ক্লাস্টার গড়তে কমিটি
সোমবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে আতশবাজি নিয়ে ক্লাস্টার গড়তে এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এই নতুন কমিটির নাম ঘোষণা করেন। মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে এই কমিটিতে রয়েছেন অর্থ, দমকল, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, পরিবেশ ও পুর নগরোন্নয়ন সচিব। এই কমিটি আগামী ২ মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে একটি রিপোর্ট দেবে। তার ভিত্তিতে ক্লাস্টার গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করতেই এই উদ্যোগ বলে মনে করা হচ্ছে। ফিরহাদ বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের অনেক পরিত্যক্ত জমি পড়ে রয়েছে। সেখানে ক্লাস্টার গড়ে জেলাভিত্তিক সবুজ বাজি তৈরি করা যেতে পারে। যে সমস্ত বাজি বেআইনি নয়, মূলত সেই বাজিগুলিই ক্লাস্টারে তৈরি হবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘সম্প্রতি কয়েকটি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে। আমরাও ছোটবেলায় দেখতাম বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হত। সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরে একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বাজি বিষয়ে আজ মন্ত্রিসভার বৈঠকে একটি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। তাতে সম্মতি দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন এই ক্লাস্টার তৈরি হলে, জেলায় ঘরের কাছে থেকেই যেমন কাজ পাওয়া যাবে। তেমনই পরিবেশবান্ধব বাজিও তৈরি করা যাবে।’’
বজবজকাণ্ড নিয়ে শুভেন্দু
বজবজের ঘটনায় রাজ্য সরকারকে দায়ী করে টুইট করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। এনআইএ তদন্তের দাবি করেছেন বিরোধী দলনেতা। টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘‘২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। আমি মনে করি, কেউ যদি হিসাব এবং তুলনা করেন, তা হলে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনে যত বিস্ফোরণ হয়েছে, তার থেকে বেশি বিস্ফোরণ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বার বার এক কথা শুনতে লাগলেও, এই ঘটনাতেও এনআইএ তদন্ত দরকার।’’ বাজি ক্লাস্টার নিয়ে চুঁচুড়ায় শুভেন্দুর মন্তব্য, ‘‘ভোটের রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বজবজে ৩৪ জন বাজি ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়েছেন। সেখানে প্রচুর পরিমাণ বাজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। পরে হিসাব করে সরকার দেখেছে, বাজির সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ লোক। তাই আইনি পথ বাছা। এটা কোনও প্রশাসনের কথা হতে পারে না। অন্যথায় কন্ট্রোল বোর্ড ও বর্তমানে যে পদ্ধতিতে শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে, সেই পদ্ধতিতে সকলের লাইসেন্স আছে কি না, দেখে নেওয়া উচিত। কারণ, মানুষের জীবনের দাম অনেক বেশি।’’
বজবজকাণ্ড নিয়ে সুজন, অধীর
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পূর্ব মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ বা বীরভূমে সাম্প্রতিক কালে যে সব ঘটনা ঘটেছে, সেখানে বাজি কারখানার আড়ালে বোমা তৈরি হচ্ছিল। এই কারবার চলছে শাসক দলের প্রশ্রয়ে। সেই ব্যাপারে প্রশাসন কী ভূমিকা নেবে?’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ধুবুলিয়ায় বলেছেন, ‘‘পরপর ঘটনা ঘটছে, পশ্চিমবঙ্গে এত বাজির প্রয়োজন কেন হচ্ছে? আমরা কি প্রতি দিন কেউ বাজি পোড়াই? এখন তো পুজোর সময়েও শব্দবাজি ব্যবহার করা যায় না। এর একটা আলাদা তদন্ত হওয়া দরকার। এই বাজির কারখানাগুলো তো প্রকৃত অর্থে তৃণমূলের বোমার কারখানা।’’ বাজি ক্লাস্টার নিয়ে সুজন বলেন, ‘‘এই রকম ক্লাস্টারের পরিকল্পনা আগেই হয়েছিল। বাম সরকারের আমলে শিবগঙ্গা-সহ বাজি তৈরির তালুকগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও হয়েছিল। দায়িত্বে ছিলেন সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকেরা। তার পরে ১২ বছরে কী হল?’’
বজবজকাণ্ড নিয়ে কুণাল
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘সামগ্রিক ভাবে বাজি শিল্পকে বোমা তৈরির শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করে একটা বড় অংশের মানুষের জীবিকা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এটা একটা অংসগঠিত শিল্প। তবু নিশ্চয়ই দেখতে হবে, কোথায় কোথায় আইন ভেঙে তা চলছে।’’ বিপুল মশলা মজুত রাখা নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ সম্পর্কে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘বাজির কারখানায় তো বাজির মশলাই থাকবে! ওখানে কি বিরিয়ানির মশলা থাকবে?’’
কী হয়েছিল রবিবার রাতে
রবিবার সন্ধ্যা পৌনে ৮টা নাগাদ নন্দরামপুর দাসপাড়ায় একটি বাড়িতে বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা পাড়া। বিস্ফোরণের পরেই ওই বাড়ির দোতলার ঘরটি দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। স্থানীয় লোকজনই ওই ঘর থেকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তিন জনকে উদ্ধার করে। পরে তাঁদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃতাদের নাম পম্পা ঘাঁটি, জয়শ্রী ঘাঁটি এবং যমুনা দাস। বছর দশেকের বালিকা পম্পার মা জয়শ্রী। যমুনার সঙ্গে ওই মা-মেয়ের সম্পর্ক কী, তা জানা যায়নি। স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই বাড়িতে বেশ কিছু দিন ধরেই বেআইনি বাজি মজুত করে রাখা হচ্ছিল। শুধু মজুত নয়, বেআইনি ভাবে বাজি তৈরিও চলছিল সেখানে। কোনও ভাবে সেই মজুত বাজিতে আগুন লেগে বিস্ফোরণ হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়িটি জয়দেব ঘাঁটি নামে এক ব্যক্তির। সরকারি অনুমতি ছাড়াই কী ভাবে ওই বাড়িতে বেআইনি বাজি মজুত করা হচ্ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy