Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে জটের মধ্যেই ভোটের দফা বৃদ্ধির দাবি, শুভেন্দু, নওশাদের পর সরব অধীরও

বাহিনী নিয়ে রাজনৈতিক এবং আইনি লড়াইয়ের পর ভোটে দফা বাড়ানো নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। কমিশন এক দিনে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিলেও কোর্টের রায়ের পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বিরোধী মহলে।

An image of Adhir Chowdhury

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৩ ২৩:২৮
Share: Save:

পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে জট এখনও কাটেনি। এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ৩৩৭ (প্রথমে ২২, পরে ৩১৫) কোম্পানি বাহিনী পাঠাতে রাজি হলেও বাকি ৪৮৫ কোম্পানি বাহিনী নিয়ে টানাপড়েন চলছেই। তার মধ্যেই ভোটের দফা বাড়ানোর দাবিতে আবার সরব বিরোধীরা। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ মতো কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের ‘বাস্তবতা’ দেখিয়ে একাধিক দফায় পঞ্চায়েত ভোটের দাবি আগেই তুলেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি। এ বার দফা বাড়ানোর দাবিতে আদালতে যাওয়ার কথা বললেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও।

কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে রাজনৈতিক এবং আইনি লড়াইয়ের পর পঞ্চায়েত ভোটে দফা বাড়ানো নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এক দিনে গোটা রাজ্যে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিলেও বাহিনী নিয়ে কোর্টের রায়ের পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বিরোধী মহলে। পাঁচ দফায় ভোট চেয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। সম্প্রতি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহের সঙ্গে বৈঠকে দফা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে এসেছেন শুভেন্দুও। কিন্তু তিনি ক’দফা চান, তা অবশ্য নির্দিষ্ট করেননি বিরোধী দলনেতা। তিনি বলেন, ‘‘দফা বাড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প পথ নেই। হাই কোর্ট গোটা নির্বাচনকে যে ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় সম্পন্ন করতে বলেছে, তাতে প্রয়োজনীয় বাহিনী এক দফায় পাওয়া সম্ভব নয়। দফা বাড়াতেই হবে।’’ হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে যদি যথেষ্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী পঞ্চায়েত ভোটে মোতায়েন না করা যায়, তবে এক দফার বদলে একাধিক দফায় ভোট করানোর দাবি তুলেছেন ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ। অধীরের দফা বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি অবশ্য সরাসরি বাহিনীকেন্দ্রীক নয়। তাঁর বক্তব্য, ভোটে অশান্তি রুখতেই দফা বাড়ানো জরুরি। অধীরের দাবিকে সমর্থন করেছে সিপিএম। বিজেপি সমর্থন করার পাশাপাশি অধীর এবং তাঁর দল কংগ্রেসের ‘নীতিগত’ অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

শাসক তৃণমূল অবশ্য দফা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রথম থেকেই উদাসীন। বিরোধীদের দাবিতে আপত্তি বা সম্মতি কোনও কিছুই তারা জানায়নি। তাদের বক্তব্য, আট দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করিয়েও ফলাফল কী হতে পারে, তা গত বিধানসভা নির্বাচনেই বুঝতে পেরেছে বিরোধীরা। শাসকদল ভোটের দফা নিয়ে ভাবিত নয়। অধীরকে প্রদেশ কংগ্রেসের ‘ব্যর্থতম’ সভাপতি বলে কটাক্ষও করেছেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ।

অধীর দফার বাড়ানোর দাবি তুলেছেন ভোট লুট ঠেকাতে। অন্য দিকে, দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ভোট লুট প্রতিরোধের ফর্মুলা বাতলে দিয়েছেন শুভেন্দু। বিরোধী দলনেতার পাঁচ দফা দাওয়াইয়ের মধ্যে রয়েছে— ব্যালট বাক্সে পদ্ম ফুলের স্টিকার লাগানো, স্ট্রং রুমে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত কড়া পাহাড়া এবং আশপাশের বাড়ি থেকে দূরবীন ও ক্যামেরায় নজরদারি।

পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সরগরম পাহাড়ও। সেখানে যাতে পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়, সেই দাবিতে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে মহাজোট। তাদের দাবি, ভোটের সময় এবং ভোট পরবর্তী হিংসা রুখতে পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রয়োজন। দেখা উচিত, যাতে বুথে বুথে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপত্তারক্ষী থাকেন।

দফা বাড়ানোর দাবি অধীরের

বৃহস্পতিবার বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ জেলার কংগ্রেসের দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করেন অধীর। তিনি বলেন, ‘‘দফা বাড়ানো দরকার। আদালতের কাছে আমি আবার দাবি করব, আগামী সোমবার যেন দফা বাড়ানো হয়। না হলে প্রহসন হবে এই নির্বাচন।’’ পাশাপাশি, পঞ্চায়েত ভোটে অশান্তির আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “যদি সন্ত্রাসমুক্ত ভোট হয়, সেটাই জানব বাংলার জন্য বিরাট পাওনা।’’ প্রসঙ্গত, সামনের সোমবার কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শুনানি রয়েছে হাই কোর্টে। আদালতের কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত নির্দেশ কার্যকর করার রিপোর্ট সেই দিনই কোর্টে জমা দেওয়ার কথা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। পাশাপাশি, আগামী সোমবারের মধ্যে ৪৮৫ কোম্পানি বাহিনী নিয়ে টানাপড়েনের মীমাংসা না হলে, সেটিও শুনানিতে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে দফা বাড়ানোর বিষয়টিও উত্থাপিত করা হবে বলে জানান অধীর। এ ছাড়া পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বে হিংসা বিধ্বস্ত ভাঙড়, ক্যানিংয়ের মতো জায়গায় রাজ্যপাল বোসের সরেজমিনে পরিদর্শনকে স্বাগত জানিয়েছেন অধীর। তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো চাই রাজ্যপাল সক্রিয় হোন। কারণ, তিনিও আমাদের রাজ্যের এক জন পদাধিকারী। আমরা চাইব, এ রাজ্যটা কী ভাবে চলছে তিনি দেখুন।’’ রাজ্যের কোথায় কী হচ্ছে, তা দেখা রাজ্যপালের অধিকারের মধ্যে পড়ে বলেও জানিয়েছেন অধীর। পঞ্চায়েত ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্য নির্বাচন কমিশনেরও তীব্র সমালোচনা করেন অধীর। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এটা নির্বাচন কমিশন নয়, তৃণমূলের কমিশন।’’ ভোটে অশান্তি হতে পারে এমন বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে যেতে দেওয়া হবে না বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কংগ্রেস নেতা। বৃহস্পতিবার বহরমপুর থেকেই পঞ্চায়েত ভোটে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করা হয়েছে।

দফা নিয়ে সিপিএম, বিজেপি

অধীরের দাবির প্রেক্ষিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘মানুষের অধিকারকে সুরক্ষিত করার মনোভাব নিয়ে চলেনি নির্বাচন কমিশন। এটা তো ঠিকই যে, বেশি দফা হলে বাহিনী পাঠাতে সুবিধা হবে। নির্বাচন কমিশন, আদালত বিচার করুক।’’ বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অধীর চৌধুরী যে রাজনৈতিক দলের হয়ে এ কথা বলছেন, তারাই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সহযোগিতা করে। তৃণমূলকে দুর্নীতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সব চেয়ে বড় সহযোগী হল কংগ্রেস। অধীরবাবু সম্পর্কে আমাদের একটাই বক্তব্য— রাইট প্লেয়ার প্লেয়িং ইন অ্যা রং কোর্ট!’’

অধীরের দাবি নিয়ে তৃণমূল

তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল বলেন, ‘‘অধীর চৌধুরী এগুলো অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে আট দফায় ভোট হয়েছিল। সিপিএমের সঙ্গে জোট ছিল অধীরবাবুদের। ওই ভোটে শূন্য পেয়েছে ওরা। লজ্জা করে না! প্রদেশ কংগ্রেসের ব্যর্থতম সভাপতি। ওঁর কাছে আট দফাই বা কী আর এক দফাই বা কী!’’

শুভেন্দুর পাঁচ দাওয়াই

পঞ্চায়েতে ভোট লুট ঠেকাতে পাঁচ দফা দাওয়াই দিয়েছেন শুভেন্দুর। দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ নিয়ে বুথ লুট করতে আসতে পারে তৃণমূল। বুথ লুঠ করতে এলে ব্যালট বাক্স পুকুরে ফেলে দেবেন। বাক্সে পদ্ম ফুলের সিল লাগাবেন, যাতে ভাঙতে না পারে। আর স্ট্রং রুমে নিয়ে যাওয়ার সময় ব্যালট বাক্স পাহারা দিতে হবে সামনে-পিছনে। স্ট্রং রুমের আশপাশের বাড়ি থেকে দূরবীন, ক্যামেরায় নজরদারি করতে হবে।’’ বিরোধী দলনেতার স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘ভোট থেকে গণনা— রাত জাগতে হবে, তা হলেই তৃণমূল যাবে।’’

বোসকে স্মারকলিপি

দীর্ঘ প্রায় দু’দশক পর পাহাড়ে পঞ্চায়েত ভোট হচ্ছে। সেখানে দ্বিস্তরীয় পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা। সেই ভোটে যথাযথ নিরাপত্তার দাবি তুলে রাজ্যপাল বোসের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দিলেন পাহাড়ে তৃণমূল-বিরোধী মহাজোটের নেতারা। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, জিএনএলএফ-সহ একাধিক তৃণমূল-বিরোধী দলের নেতারা রাজ্যপালের কাছে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানান। গত জিটিএ ভোটের পর থেকেই পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গিয়েছে। পুরভোটে বিপুল জয়ের পরেও দার্জিলিং পুরসভা ধরে রাখতে পারেনি হামরো পার্টি। পাহাড়ের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাও এখন স্রেফ অতীতের ছায়া। ক্রমশ শক্তি বাড়াচ্ছে অনীত থাপার ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা। ডানা মেলছে তৃণমূলও। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল-বিরোধী মহাজোট করে এক ছাতার তলায় এসেছেন বিমল গুরুং, অজয় এডওয়ার্ডরা। দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজুর নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে রাজ্যপালের সঙ্গে পৌনে এক ঘণ্টা বৈঠক সারল সেই মহাজোট। মূল দাবি, পাহাড়ের পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন। রাজু বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিগত দিনে চোপড়ার ঘটনা সম্পর্কে আমরা অবগত। পাহাড়ে নোংরা রাজনীতি চালাচ্ছে তৃণমূল ও অনিত থাপার দল। মহাজোটের দলগুলিকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ে গণতন্ত্র বলে আর কিছু নেই। রাজ্যপালের কাছে আমাদের আবেদন, সমস্ত বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাই। ভোট পরবর্তী হিংসা রুখতে আমাদের আরও আবেদন, ভোট শেষ হওয়ার পর ছ’সপ্তাহ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী সেই জেলাতেই মোতায়েন থাকুক। গোলমালের সমস্ত ঘটনাই জেলাশাসক ও এসপিকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।’’ বৈঠক শেষে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘শান্তির বাতাবরণে নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচন এবং ভোট পরবর্তী হিংসা রুখতে কেন্দ্রীয় বাহিনী রেখে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ওঁরা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ করেছেন। উচ্চ আদালতের যে রায় রয়েছে, তা মেনেই ভোট হওয়া দরকার। এ সব কারণেই আমি ‘গ্রাউন্ড জ়িরো’ থেকে কাজ শুরু করেছি।’’ প্রত্যাশিত ভাবেই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে অনীতের দল। দলের মুখপাত্র এসপি শর্মা বলেন, ‘‘সব থেকে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পাহাড়েই হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত কোনও হিংসার খবর নেই। জিটিএ নির্বাচনও একই ভাবে হয়েছিল। আমরা গানবাজনার মাধ্যমে নির্বাচনে প্রচার করছি। আসলে, মহাজোট শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে হরেক রকম অজুহাত তৈরি করছে। ওদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া নেই!’’ দার্জিলিং জেলা তৃণমূলের সভাপতি (পাহাড়) শান্তা ছেত্রী বলেন, ‘‘ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। অন্য সময় এদের দেখা যায় না, শুধুমাত্র ভোটের সময় কোথা থেকে যেন উঠে আসে। পাহাড় সম্পূর্ণ শান্ত। দয়া করে তাতে ঘি ঢালতে যাবেন না।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy