পরিশ্রমেই খুলবে সাফল্যের তালা, মনে করেন আবু সামা। নিজস্ব চিত্র।
পরের জমিতে গতরে খেটে চাষবাস করেন বাবা। দাদারাও সেই একই কাজ করেন। কিন্তু ক্ষেতমজুরির সেই বরাতও জোটে না রোজ। তখন দিনমজুরি করতে হয়। সাত ভাই-বোনের বড় পরিবার। তা না হলে চলবে কী করে? উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী আবু সামা এই পরিবারেই বড় হয়েছেন। যে পরিবারের কোনও সদস্য তাঁর আগে ষষ্ঠ শ্রেণির গাঁটও পেরোতে পারেননি!
বাড়ি উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ায়। আবুর আগে তাঁর এক দাদা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তিনিও এখন চাষবাসের কাজই করেন। বাবা-দাদাকে সাহায্য করতে আবুও চাষের কাজ করতে চাননি তা নয়। কিন্তু বাবা নিজেই চাননি ছেলে মাঠে কাজ করুক। অনেক ছোটবেলায় এক শিক্ষক আবুকে দেখে বলেছিলেন, ‘‘এ ছেলেকে কিছুতে বাধা দিও না। ও একদিন মানুষ হবে।’’ সেই কথাটিই বরাবর মনে রেখেছেন বাবা। নিজে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও তাই ছেলেকে পড়তে দিয়েছেন। আর মনে মনে আশা করেছেন, ‘‘ এক দিন নিশ্চয়ই ও ভাল কিছু হবে!’’
বৃহস্পতিবার উচ্চ মাধ্যমিকের ফল সেই ‘ভাল কিছু’র বার্তা নিয়ে এল। যার অপেক্ষা সেই মাধ্যমিকের সময় থেকে করছেন আবু, তাঁর পরিবার, এমনকি, তাঁর স্কুলও। সকলেই ভেবেছিলেন মাধ্যমিকেই রাজ্যে মেধাতালিকায় নাম তুলবেন আবু। কিন্তু কোভিডের জন্য পরীক্ষাই হল না। প্রকাশ করা হল না মেধাতালিকাও। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ শুধু জানিয়ে দিয়েছিল পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের শতাংশ। আবু ৯৪.০২ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। মেধাতালিকার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশের পর আবুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইনের। জানতে চাওয়া হয়েছিল, তবে কি স্বপ্ন পূরণ হল? না কি আরও বড় স্বপ্ন ছোঁয়ার ইচ্ছে আছে তাঁর। প্রশ্ন শুনে আবু বলেছেন, ‘‘আমি পুলিশ হতে চাই।’’
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে পুলিশ! আবু ব্যাখ্যা করে বলেছেন তিনি ইউপিএসসি দিয়ে পুলিশের কাজে যোগ দিতে চান। অর্থাৎ আইপিএস অফিসার হতে চান। তবে একই সঙ্গে আবু এ-ও জানেন এই স্বপ্ন পূরণের জন্য অনেক বেশি পরিশ্রম জরুরি। আবু বলেছেন, ‘‘আমার পরিবারকে সাহায্য করতে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। তবে তার জন্য আরও ভাল পড়াশোনা করতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে।’’
বাবা-দাদার মতো পরিশ্রমেই বিশ্বাসী আবু। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, ‘‘হার্ডওয়ার্ক ইজ দ্য ওনলি কি টু সাকসেস’’। অর্থাৎ পরিশ্রই সাফল্যের মূল কথা। আবু জানিয়েছেন, তিনি যেখানে পড়াশোনা করেন, সেখানেও ওই কথাটি লিখে রেখেছেন। কারণ তাঁর মতে পরিশ্রম দিয়ে যে কোনও যুদ্ধ জিতে নেওয়া সম্ভব। আর গত কয়েক বছরে পড়াশোনার জন্য কম পরিশ্রম করেননি তিনি।
উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা কোনও না কোনও বিষয়ে সাধারণত টিউশন নিয়ে থাকেন। আবু নেননি। বাংলা, ইংরেজি ছা়ড়াও, উচ্চমাধ্যমিকে তিনি পড়াশোনা করেছেন ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং দর্শন নিয়ে। এর মধ্যে কয়েকটি বিষয় মাধ্যমিকের সিলেবাসে থাকে না। উচ্চ মাধ্যমিকেই প্রথম পরিচিতি। আবু সমস্ত বিষয়ে নিজেই পড়াশোনা করেছেন। খুব অসুবিধা হলে সাহায্য নিয়েছেন স্কুলের শিক্ষকদের। আবুর স্কুল রামকৃষ্ণপুর প্রমোদ দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকি দত্ত জানিয়েছেন, ক্লাসের বাইরেও শিক্ষকদের সঙ্গে পড়া নিয়ে আলোচনা করতেন আবু। এমনকি, গ্রীষ্ম এবং পুজোর ছুটিতে তাঁদের স্কুলে আলাদা করে যে ক্লাস করানো হত, সেই ক্লাসেও নিয়মিত থাকতেন আবু।
একাদশ শ্রেণিতে ওঠার পর অবশ্য একটি টিউশনে ভর্তি হয়েছিলেন আবু। তার কিছু দিন পর বোন আয়েষার জন্যও টিউশনের ব্যবস্থা করতে হয়। আবুর বাবা জানিয়েছেন, সেই সময় আবু তাঁর পরিবারকে বলেছিলেন, এত টিউশনির টাকা কোথা থেকে আসবে। পরে নিজের টিউশনির ক্লাসটি ছে়ড়েও দেন এই ছাত্র। যদিও আনন্দবাজার অনলাইনকে আবু জানিয়েছেন, ওই টিউশনি পড়তে ভাল লাগছিল না বলেই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
উচ্চ মাধ্যমিকে ইতিহাসে ১০০-এ ১০০ পেয়েছেন আবু, ভূগোলে ৯৯, দর্শন এবং ইংরেজিতেই ১০০-এ ৯৯ পেয়েছেন আবু। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং বাংলায় পেয়েছেন যথাক্রমে ৯৫ এবং ৯৮ নম্বর। সব মিলিয়ে আবুর প্রাপ্ত নম্বর ৫০০-এ ৪৯৫। শতাংশের হিসাবে ৯৯.২। আর এর পুরোটাই তিনি পেয়েছেন স্কুল এবং বাড়িতে পড়াশোনা করেই।
আবুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, আবুর প্রিয় বিষয় ইতিহাস। যদিও আবুর বোন আয়েষার বক্তব্য, ‘‘দাদা আমাকে আগেই জানিয়েছিল, ইংরেজি নিয়ে পড়বে।’’ বৃহস্পতিবার আবু নিজেও স্নাতকে ইংরেজি নিয়ে পড়বেন বলেই জানিয়েছেন। তবে ‘পুলিশ হওয়া’র লক্ষ্য স্থির। আবু বলেছেন, ‘‘ইউপিএসসি দিতে চাই। আইএস নয় পুলিশ হতে চাই।’’
আবুর বাবা জানিয়েছেন, ছেলেকে দেখে ২ মেয়েকেও পড়াশোনা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক মেয়ে আয়েষা এখন দশম শ্রেণিতে পড়ে। সবচেয়ে ছোটটি এখন প্রথম শ্রেণিতে। বাবার আশা মেয়েও মাধ্যমিকে ভাল ফল করবে। তাঁর কথায়, ‘‘ওরাও পড়াশোনায় ভাল। আমার যা কষ্ট হয় হোক ওদের জন্য আমি কাজ করে যাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy