অভীক দে। ছবি: সংগৃহীত।
বদলি বা যে কোনও সিদ্ধান্ত স্থির হওয়ার পরে তা সরাসরি স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে পাঠাতেন না ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-র উঠতি নেতা অভীক দে। বরং সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ছিলেন এক জুনিয়র চিকিৎসক। যিনি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ বা চিরকুটের আকারে ‘দাদা’র নির্দেশ পৌঁছে দিতেন স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশের কাছে। রাজ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকারী বিশেষ গোষ্ঠীর কাজকর্ম পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল বিভিন্ন স্তর। সেখানে বিভিন্ন জ়োন নির্দিষ্ট করে দায়িত্ব ভাগ করা থাকত জুনিয়র চিকিৎসকদের একাংশের মধ্যে।
অভীক ও তাঁর এক শাগরেদ বলে পরিচিত বিরূপাক্ষ বিশ্বাসকে বৃহস্পতিবার সাসপেন্ড করেছে স্বাস্থ্য দফতর। চিকিৎসক মহলের একাংশের অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকে জেলা স্তরের হাসপাতালে এমন ভাবেই পুরো সিন্ডিকেট পরিচালনা করতেন অভীকেরা। আর তাঁদের সেই ক্ষমতায়নে নিজেদের স্বার্থে মদত দিতেন সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশও। ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র বিরুদ্ধে থাকা চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘অভীক, বিরূপাক্ষের মতো জুনিয়র চিকিৎসকদের কথা শুনে চলা, ওঁদের দুর্নীতি দেখেও চুপ করে থাকা যেন দস্তুর হয়ে উঠেছিল। অনেকেই ভয়ে মুখ বুঝে সব সহ্য করতেন। না হলেই ওই গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হতে হত।’’ স্বাস্থ্য প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত অনেক আধিকারিকেরও অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে অভীকদের ‘অত্যাচারের’ বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য দফতরে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি।
‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল যে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার বিশ্রাম নেওয়ার কক্ষে গিয়ে বসে থাকতেন অভীক ও তাঁর বাহিনী। সেটাই ছিল ওঁদের অস্থায়ী কার্যালয়।’’ আর জি করের ঘটনার পরেই সমস্ত মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অবাধে দাপিয়ে বেড়ানো স্বাস্থ্য-সিন্ডিকেটের ছবি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সবেতেই মাথা হিসেবে রয়েছেন অভীক। জানা যাচ্ছে, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ার সময়েই রাজ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীর প্রভাবশালী নেতা চিকিৎসক সুশান্ত রায়ের ছেলে সৌত্রিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় অভীকের। সেই সূত্র ধরেই, তিনি সুশান্তের কাছাকাছি পৌঁছে তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে ওঠেন। ‘জেঠু’ (সুশান্তকে এই নামেই ডাকেন অভীক ও তাঁর সঙ্গীরা)-র কথামতো বিভিন্ন জায়গায় লিঙ্কম্যানের কাজ শুরু করেন অভীক।
তাঁর সমসাময়িক চিকিৎসকেরা অভিযোগ করছেন, নিজের ছেলেকে সরাসরি সামনে আনেননি সুশান্ত। বদলে তিনি অভীককে ক্রমশ ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র নেতা হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেন। কিন্তু সেটা ছিল উত্তরবঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ। চিকিৎসক মহলের খবর, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে ২০২১-এ কোভিডের সময় থেকে। সিনিয়র শিক্ষক চিকিৎসকদের করোনা পরিস্থিতিতে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে নাক গলাতে শুরু করে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’। সেই সময়েও অবশ্য পুরোপুরি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেনি। তবে করোনা পর্বে প্রশাসনিক বিভিন্ন বিষয়ে সাফল্য মিলতে থাকায় ওই লবিতে এসে যোগ দেন কিছু সুযোগসন্ধানী চিকিৎসক। তৈরি হয় সিন্ডিকেট। তাতে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পড়ে অভীকের উপরে। তখন তিনি বর্ধমান মেডিক্যালের আরএমও।
‘জেঠু’র নির্দেশে একের পর এক কাজে ‘সাফল্য’ মেলায় অভীক সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। এমনকি ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-র প্রকৃত কান্ডারি এক সিনিয়র চিকিৎসকেরও সুনজরে চলে আসেন অভীক। তাতেই তাঁর দাপট পাহাড় থেকে সমতল, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ, সেই ক্ষমতাবলে বদলি, পদোন্নতি, প্রশ্ন ফাঁস থেকে শুরু করে বিভিন্ন দুর্নীতিতে নাম জড়াতে থাকে অভীকের। কিন্তু মাথার উপরে ‘লবি’র কান্ডারি’র হাত থাকায়, সবেতেই তাঁর সাত খুন মাফ ছিল বলেই অভিযোগ। ক্রমশ প্রভাব বাড়লেও, ‘জেঠু’-র প্রতি আনুগত্য এত টুকুও কমেনি অভীকের। বরং পুরস্কার হিসেবে ২০২২ সালে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন কমিটিতে ঢুকে পড়েন অভীক। অভিযোগ, বিশেষ সুবিধা কাজে লাগিয়ে পিজিতে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার সুযোগও পান। ব্যক্তি-ক্ষমতার সেই প্রভাবেই কি আর জি করের সেমিনার রুমে তাঁর উপস্থিতি ছিল? প্রশ্ন এখন সর্বত্র।
‘উত্তরবঙ্গ লবি’ এবং তাঁর ভূমিকা নিয়ে সুশান্ত রায়কে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। রাত পর্যন্ত মেসেজের উত্তর দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy