লাগাতার অভিযানে অনেক প্রতারকই ধরা পড়ে। প্রতীকী ছবি।
এখানে মোটরবাইক দাঁড়ানো মানা। ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে যেতে হবে।
সেই ভাবেই চলতে চলতে নজরে পড়ছিল ছোট ছোট টিলা, এখানে ওখানে ঝোপঝাড়। আর বিঘার পর বিঘা অনাবাদী জমি। ধুলো উড়ছে মাঠ থেকে। গ্রীষ্মের ঠিক মুখে এই মাঠ আর তথাকথিত খেতজমির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে মনে হচ্ছিল, এখানকার লোক জীবনধারণ করেন কী ভাবে?
সঙ্গী পঞ্চায়েত সদস্য জানালেন, চাষবাস হয়। বর্ষার পরে কিছুটা হলেও সজল হয় এলাকা। মাঠেঘাটে প্রাণ আসে। তখন ধান আর ভুট্টা চাষ শুরু হয়। তাতেই যা কিছু রোজগার জামতাড়ার সাধারণ মানুষের। তিনি বলছিলেন, ‘‘এদের হতদরিদ্রই বলা যায়।’’ গোটা এলাকায় সব মিলিয়ে লাখ দেড়েক মানুষের বসবাস। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি। হিন্দি তো আছেই, অনেকে বাংলাতেও কথা বলেন। তবে সাধারণ মানুষের নিজস্ব কথ্য ভাষা আছে, যা চট করে বোঝা কঠিন। এর মধ্যেই সঙ্গী সাবধান করলেন, ‘‘গাড়ি থামাবেন না। ওরা দ্রুত বুঝে যায়, কারা বাইরে থেকে এসেছে।’’
চোখে পড়ল কুঁড়েঘর। মাঠে ছোট ছোট মাচা। প্রত্যন্ত এলাকায় যাওয়ার রাস্তা কংক্রিটের। সেই পথ ধরে মণ্ডলপাড়া, রশিকপাড়া, নিমটোরের মতো এলাকা ঘুরে বোঝা গেল, গোটা অঞ্চলটি কতটা গরিব। সঙ্গীর কথায়, ‘‘সে জন্যই অপরাধপ্রবণতা বেশি।’’ এই সবের মধ্যে আরও একটা বিষয় নজরে এল। কুঁড়ে আর গাছপালার পিছনে পেল্লাই দালানবাড়ি। একটি, দু’টি নয়। বেশ কয়েকটি। কোনও বাড়ির সামনে গাড়ি, কোনওটির সামনে দামি মোটরবাইক রাখা। বহু লক্ষ টাকা মূল্যের এই সব বাড়ির মালিকেরাই নাকি সাইবার অপরাধের মূল চক্রী। তবে দিনের আলোয় তাদের বিশেষ দেখা যায় না। আরও একটি বিষয় নজরে পড়ার মতো, এলাকায় প্রচুর সংখ্যায় মোবাইল টাওয়ার।
পুলিশ সূত্রে জানা গেল, লাগাতার অভিযানে অনেক প্রতারকই ধরা পড়ে। মানুষও সচেতন হয়ে ওঠে। ফলে, জামতাড়ার চক্রীরা দু’টি সিদ্ধান্ত নিল। এক, তারা প্রতারণার নিত্যনতুন পদ্ধতি বার করা শুরু করল।
দুই, প্রতারণার টাকা আর সরাসরি নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আনল না। পুলিশের কথায়, চক্রীরা ব্যবহার করতে শুরু করল গ্রামের গরিব মানুষের অ্যাকাউন্ট। প্রথমে সেখানে জমা পড়ল লুট করা টাকা। তার পরে তা তুলে নেওয়া হল। অ্যাকাউন্ট ‘ভাড়া’ নেওয়ার বিনিময়ে গরিব মানুষগুলিকে কিছু টাকা দেওয়া হল।
পুলিশের মতে, এই কাজে দু’ভাবে এগোল প্রতারকেরা। প্রথমত, খুঁজে বার করা হল, এলাকায় কাদের ‘জনধন’ অ্যাকাউন্ট আছে। সেই গরিবগুর্বোদের কাছে চক্রীরা শর্ত দিল, লেনদেনের বিনিময়ে তাঁদের টাকা দেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত, এলাকার হতদরিদ্র কয়েক জনকে তারা নিজেরাই অ্যাকাউন্ট খুলে দিল। ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে সেখান থেকে তুলে নিল নিজের ভাগ। ফলে, চক্রীদের অ্যাকাউন্ট রয়ে গেল অন্ধকারেই।
প্রথমে পুলিশ ধরতে পারেনি এই চালাকি। অ্যাকাউন্টের সূত্রে কয়েক জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই অ্যাকাউন্ট ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি জানা যায়। ধৃতেরা বেশির ভাগই গরিব মানুষ। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা জানতেনই না যে, প্রতারণার টাকা নিজেদের অ্যাকাউন্টে এই ভাবে লেনদেন করা অপরাধ। জামতাড়া পুলিশের সাইবার অপরাধ দমন শাখার ডিএসপি মজরুল হোদা বলেন, ‘‘নিয়মিত অভিযানে গ্রামের গরিব পরিবারগুলিকে অপরাধের বিষয়টি বোঝানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখনও অনেকে সামান্য অর্থের লোভে প্রতারকদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন।’’
প্রতারকদের নিয়েও চমকপ্রদ কথা শোনালেন মজরুল। তিনি বলেন, ‘‘সাইবার অপরাধ দমন শাখার আধিকারিকেরা প্রথম দিকে এই প্রতারকদের কাছে জানতে চান, কেন তারা এমন কাজে যুক্ত? প্রতারকেরা তখন বলেছিল, তারা নিজেদের বুদ্ধিবলে রোজগার করছে। এটা কোনও অপরাধ বলেই তারা মনে করে না!’’
এ সব তথ্য শোনাতে শোনাতে জামতাড়া থানার এক পুলিশ অফিসার বলেন, ‘‘তা হলেই বুঝুন, কতটা গভীরে গিয়েছে প্রতারণাচক্র। আর কতটা লাভদায়ক!’’ এক পুলিশকর্মীর আক্ষেপ, ‘‘একটা এলাকা বিখ্যাত হয়ে গেল স্রেফ প্রতারণার জন্য। সেখানকার পুলিশকেও এই কুখ্যাতির ভার বহন করতে হয়!’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy