Advertisement
E-Paper

সন্দীপের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সুদীপ্তের বিরুদ্ধে, ‘সব মিথ্যা কথা’, দাবি তৃণমূল বিধায়কের

সুদীপ্তকে প্রশ্ন করা হয়, সন্দীপ ঘোষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি কখনও কেন মুখ খোলেননি? উল্টে প্রকাশ্যে সন্দীপের প্রশংসা করে বেড়িয়েছেন? তাঁর জবাব, ‘‘হাসপাতাল পরিচালনার কাজে ঢুকতাম না।’’

(বাঁ দিকে) আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি তথা তৃণমূল বিধায়ক সুদীপ্ত রায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

(বাঁ দিকে) আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি তথা তৃণমূল বিধায়ক সুদীপ্ত রায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:২৯
Share
Save

পুরনো চিকিৎসা সামগ্রী, যন্ত্রপাতি এবং আসবাব মেরামত করে, রং ও পালিশ করে তাতে নতুন সিরিয়াল নম্বর ও ট্যাগ লাগিয়ে নতুনের দামে কিছু সংস্থা থেকে সরকারি টাকায় কেনা হত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা চিকিৎসা সামগ্রী, যন্ত্রপাতি বিনা পয়সায় পাঠিয়ে দিত তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক তথা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান সুদীপ্ত রায়ের সিঁথির নার্সিংহোমে—এ বার এই অভিযোগ করেছেন হাওড়ার একটি সংস্থার প্রধান সুব্রত বসু। আর জি কর হাসপাতালে দীর্ঘ দিন জিনিসপত্র সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত তাঁর সংস্থা।

আর জি করে সাফাইকর্মী সরবরাহকারী একটি সংস্থার দায়িত্বে থাকা বাপ্পা ভট্টাচার্যেরও অভিযোগ, ২০২৩ সাল থেকে আর জি করে নিযুক্ত সাফাইকর্মীদের মধ্যে থেকে তিন জনকে (জন্মেজয় মাহাতো, সিমরন সিংহ এবং আয়ুব খান) পাকাপাকি ভাবে সুদীপ্তের নার্সিংহোমে কাজে নিয়োগ করতে হয়েছিল। এঁদের বেতন সুদীপ্ত রায় দিতেন না। দিতে হত সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেই। সিবিআইয়ের কাছে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন বলে দাবি বাপ্পা ভট্টাচার্যের। তাঁর আরও দাবি, ‘‘রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান হওয়ার পর সুদীপ্ত রায় আমাকে হাসপাতালে ডেকে নার্সিংহোমের পরিকাঠামো সংক্রান্ত বিভিন্ন জিনিস নিখরচায় করে দিতে বলতেন। এমনকি, সিঙ্গুরে ওঁর বাগানবাড়িতে আমাদের সংস্থাকে প্রচুর টাকার গাছ লাগিয়ে দিয়ে আসতে হয়েছিল।’’

আর জি করের ট্রমা কেয়ার ইমার্জেন্সি থেকে অনেক রোগীকে নিয়মিত সুদীপ্ত রায়ের নার্সিংহোমে পাঠানো হত এবং দু’-তিন জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীকে এই কাজে লাগানো হয়েছিল বলে তদন্তকারীদের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে। আবার বিধায়কের নার্সিংহোমে হঠাৎ কোনও রোগীর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে দ্রুত আর জি করে পাঠিয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু ছিল বলে অভিযোগ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। আর জি করের ট্রমা কেয়ার ইমার্জেন্সির দুই কর্মীর নামও তদন্তকারীদের কাছে জমা পড়েছে।

এই সব অভিযোগ সম্পর্কে সুদীপ্ত রায়ের বক্তব্য, ‘‘পুরোপুরি মিথ্যা কথা। আমার বাড়িতে আর নার্সিংহোমে ইডি-র অফিসারেরা এসে ২০ ঘণ্টা তল্লাশি করেছেন। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু কিছুই পাননি।’’

২০২৩ সালের ১৭ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে আর জি কর হাসপাতালে দুর্নীতি এবং তাতে তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান চিকিৎসক-নেতা সুদীপ্ত রায়ের প্রত্যক্ষ মদতের অভিযোগ করেছিলেন প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি। তিনি সুদীপ্ত সম্পর্কে লিখিত অভিযোগ করেন স্বাস্থ্য দফতরেও। কিন্তু সেই সময়ে তদন্ত এগোয়নি।

আর জি কর কাণ্ডের পরে আখতার আলির অভিযোগের ভিত্তিতে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তে নেমেছে সিবিআই। এই পরিস্থিতিতে সুদীপ্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও দুর্নীতিতে জড়িত বলে নতুন অভিযোগ জমা পড়েছে রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশনে।

এ বার আর জি করের ক্ষেত্রে অভিযোগ তুলেছেন দু’জন। সুব্রতের দাবি, ‘‘সুদীপ্ত রায়ের নার্সিংহোমে ২০২২-’২৪ এর মধ্যে যে সব চিকিৎসাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, সেগুলির বিল খতিয়ে দেখা উচিত। সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে যে টাকা মেটানো হয়েছে বলে বিলে দেখানো হয়েছে, সেই টাকা সেই সংস্থার অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে কি না, সেটাও দেখা দরকার।’’

সুব্রতের অভিযোগ, সন্দীপ ঘোষের সঙ্গে দুই ঠিকাদারের আঁতাঁত তৈরি হয়েছিল এবং তাতে মদত জুগিয়ে গিয়েছেন সুদীপ্ত। কোভিডের সময়ে এক ঠিকাদার রাজ্য ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ন নিগমের তালিকায় নাম লিখিয়েছিল। সেই সূত্রেই বিভিন্ন পুরনো যন্ত্রপাতি জোগাড় করে সারিয়ে নতুন হিসাবে সেগুলি সরকারি টাকায় আর জি করে কেনার বিষয়টি সে নিয়ন্ত্রণ করত বলে তাঁর অভিযোগ।

সুব্রতের কথায়, ‘‘যন্ত্রপাতির যে সব স্পেয়ার পার্টস খোলা বাজারে পাওয়া যেত না, সেগুলি কোন কোন সংস্থায় মিলবে তা সন্দীপ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গেরা আমার কাছ থেকে জানত। তার পর সেই সংস্থাগুলোকে ডেকে গোপনে বৈঠক করত। যারা ওদের ৩০-৪০ শতাংশ কাটমানি দিতে রাজি হত, তাদের বরাত দেওয়া হত। টাকা না পাওয়া পর্যন্ত ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হত না। সুদীপ্ত রায় সব জানতেন। ওঁর নার্সিংহোমে গিয়ে আমাকে একাধিক বার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সারিয়ে আসতে হয়েছে। এক বছরের মধ্যে সেই নার্সিংহোমের ভোল বদলে গিয়েছিল।’’

আখতার আলির অভিযোগ, ‘‘সন্দীপ আর সুদীপ্ত রায়ের দুর্নীতি প্রকাশ্যে এনেছিলাম বলে সুদীপ্ত আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন এবং আমাকে হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড, তার পর মুর্শিদাবাদে বদলি করে দেন।’’ যদিও সুদীপ্তের দাবি, ‘‘আখতারকে হুমকি দিইনি। বদলি করার ক্ষমতাও আমার ছিল না।’’

সুদীপ্তকে প্রশ্ন করা হয়, সন্দীপ ঘোষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি কখনও কেন মুখ খোলেননি? উল্টে প্রকাশ্যে সন্দীপের প্রশংসা করে বেড়িয়েছেন? তাঁর জবাব, ‘‘হাসপাতাল পরিচালনার কাজে ঢুকতাম না। আমার শুধু ‘অ্যাডভাইজ়রি’ পদ ছিল। ফলে সন্দীপ ভিতরে কী গোলমাল করছে, আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। সেও সরকারের নিযুক্ত, আমিও সরকারি লোক। তাঁকে খারাপ বলার মতো কোনও অবস্থা ছিল না।’’

তবে চিকিৎসকদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর তরফে চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর দাবি, ‘‘সুদীপ্ত রায় যে সন্দীপ ঘোষের দুর্নীতি চক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আর জি কর থেকে যে ওঁর নার্সিংহোমে নিয়মিত যন্ত্রপাতি, ওষুধ, রোগী পাঠানো হত, সেটা আর জি করের সিনিয়র চিকিৎসকদের সকলেই জানেন।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

R G Kar Hospital Sudipto Roy Sandip Ghosh CBI

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}