Advertisement
০৮ অক্টোবর ২০২৪
Acid Attack Victim

আলোয় ফেরার স্বপ্নে আলোর ঘরদোর

সবাই বলে, আলো (নাম পরিবর্তিত) যখন বর্ধমান জেলার ওই পাড়ায় এসেছিল, ওর মতো আর কেউ ছিল না। কোথায় কার বাবু গায়ে হাত তুলেছে, আলো ছুটল প্রতিবাদ করতে।

—প্রতীকী চিত্র।

উষসী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:৩০
Share: Save:

বিকেল থেকে অঝোরে বৃষ্টি। জলে-কাদায় ডুবে আছে পাড়া। সে তিরিশ-বত্রিশ বছর আগের কথা। ছোট ছোট দরমার ঘর, বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। সন্ধ্যা হলে গোটা পাড়ায় দুটো জেনারেটর। সে দিন জেনারেটরও বিগড়ে গেল। স্যাঁতসেঁতে ঝুপড়ির ছোট্ট চৌকিতে শুয়ে রেডিয়ো শুনছেন বাবু। ষোড়শী পাশে এলিয়ে পড়ে আছে। আজ আর পেশায় যাবে না সে। বাবুকে বলবে দোকানে না যেতে, রাতে খিচুড়ি বানাবে। মনে পড়ে গেল, সন্ধ্যা দেওয়া হয়নি। ঘর থেকে বেরোতে গিয়েই...তরল কিছুর ঝাপটা দিয়ে বৃষ্টিতে মিলিয়ে গেল একটা ছায়া। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল সে— শরীরের ডান দিকটা জ্বলছে। মুখ, মাথা, গলা, বুক— সব পুড়ছে। জ্বলছে।

সবাই বলে, আলো (নাম পরিবর্তিত) যখন বর্ধমান জেলার ওই পাড়ায় এসেছিল, ওর মতো আর কেউ ছিল না। কোথায় কার বাবু গায়ে হাত তুলেছে, আলো ছুটল প্রতিবাদ করতে। পুলিশের সঙ্গে তর্ক করতেও দু’বার ভাবত না। তখন পাড়ার মেয়েদের কেউ মানুষ বলেই মনে করত না। এক দিকে গুন্ডাদের অত্যাচার, আর এক দিকে পুলিশের তোলাবাজি। আলো প্রতিবাদ করেছিল। বাকি মেয়েরা পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে থাকল। রাগে, অভিমানে কেঁদে কেঁদে মেয়েটা একাই ক্ষোভ উগরে গেল।

এ সব কথা মনে পড়লে আলোর ভিতরটা এখন ঢিপ ঢিপ করে। এমন প্রতিবাদের ফলই হয়তো ওকে পেতে হয়েছিল।

সে বার দু’দলে তুমুল মারামারি। রেশ এসে পড়ল পাড়ার মেয়েদের উপরে। দরমার ঝুপড়িগুলিতে আগুন লাগিয়ে দিল ওরা। থানা-পুলিশ হল। প্রতিবাদী আলো তখন চোদ্দো হবে। পড়াশোনা কিছুটা জানত বলে পুলিশ ডেকে দরখাস্ত লিখতে বলে। ১১ জন দুষ্কৃতীর নাম লিখে দিল সে। সেই রাতে সাত জন গ্রেফতারও হয়ে যায়। সেটাই কাল হল। গুন্ডামি আরও বেড়ে গেল। ঘরে বসে খেতে পারে না, পালিয়ে জঙ্গলে যায় তো সেখানে ভোজালি নিয়ে তাড়া করে।

শেষে প্রতিকার চেয়ে ঘেরাও করা হল মহকুমাশাসকের দফতর। নেতৃত্বে আলো। দল বেঁধে গেল বিধায়কের কাছে। তাঁর কথায় কিছুটা শান্ত হল পরিস্থিতি। আলোরও ভালবাসা হল। পেশাও চলল। দু’বছর পর হঠাৎ এক সন্ধ্যায় বাঁক নিল জীবন। মুখে এসে ঝাপটা দিল জ্বলন্ত তরল। অ্যাসিড! তার পরে, সবটাই অন্ধকার।

ছোটবেলায় রান্নাবাটি খেলার সময় হয়নি আলোর। অল্প বয়সেই মা-বাপ মরেছে। দাদা ছিল, সে-ও মরেছে। দিদির শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থেকেছিল ক’দিন। ওর বরটাও ভাল না। কারখানায় কাজ নিল আলো। সেখান থেকেই এক দিন এক কাকিমার সঙ্গে যৌনপল্লিতে। ফেরা হল না।

ছোটবেলার স্মৃতি বলতে গিয়ে আলো বার বার ঠোক্কর খান। চা বানাতে বানাতে বলেন, “একা হলে কী হবে, পাঁচ কিলো চিনিতেও মাস যায় না আমার। যখনই আমাদের মেয়েদের মিটিং হয়, যারা লিকার চা খায়, বলে আলোর হাতের চা ছাড়া খাব না। ফ্লাস্কে ভরে ভরে চা নিয়ে যাই, জানো!” ফুটন্ত জলের দিকে দৃষ্টি। বলেন, “আমাকে এখানে সবাই খুব ভালবাসে, আলো না থাকলে হবেই না। ওরাই ফিরিয়ে এনেছে আমাকে।”

দু’বছর ধরে চিকিৎসা চলেছিল। অ্যাসিডে পুড়ে গিয়েছে ডান দিকটা। একের পর এক অপারেশন। কখনও মুখ, মাথা, কখনও শরীর। চোখটা কোনও মতে বেঁচে গেল। সেই ভালবাসার বাবু চলে গেল অন্য মেয়ের সঙ্গে। সেই থেকে আজ তিরিশ বছরের বেশি হল, আলো ভাঙেননি। এখন বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ছিপছিপে চেহারা, ছটফটে স্বভাব। সেই পাড়াতেই একটা ঘর করেছেন। খাট, আলমারি, তক্তার উপরে ছয় দেবতার ছবি। এক দিকে টেবিল। তার উপরে ছোট আয়না, সামনে চিরুনি আর পাউডারের কৌটো। বলেন, “আর পেশা করি না। চুলটা সরিয়ে ফেললে আমাকে দেখে ভয় পেয়ে যাবে।”

আয়নাটিতে অবশ্য নিত্য নিজেকে দেখেন। বলেন, “এখানে সব বিক্রি হয়— শরীর, সঙ্গ, সবই। সবাই বলত, আমি বসে গল্প করলেও খদ্দের আসবে। আমি করিনি। মেয়েরাই একটা ব্যবস্থা করে দিল, কাস্টমারদের যাঁর যেমন মেয়ে লাগবে, বলে তেমন ঘরে পাঠাতাম। সে জন্য কমিশন পেতাম। তা দিয়েই চলত।’’ শ্বাস ঠেলে উঠে আসে সেই কণ্ঠে, ‘‘আর কোথায় যাব, বলো! নষ্টপাড়ার মেয়েকে কেউ ফিরিয়ে নেয় না।’’ তার পরে একগাল হাসি, ‘‘আমার এই যৌনপল্লির বোনেরা, যে যা পেরেছিল, দিয়েছিল আমাকে। মাড়-ভাত খেয়ে থাকব ভাল। তাও এদের ছেড়ে যাব না।”

ছেড়ে যাবেন কী! আলো এখন ওঁদের নেত্রী। অনেক খেটে তৈরি হয়েছে সংগঠন। যা পেশায় স্বাধীনতার কথা বলে, কর্মী পরিচয় আদায়ের জন্য লড়াই করে। আলো বুঝেছেন, এই মেয়েদের সমাজ গ্রহণ না করলে, ওঁর মতো আরও আলো আসবেন, নিভে যাবেন। বা এমনই প্রতিহিংসার শিকার হবেন। কেউ তাঁদের হয়ে লড়বে না।

ছ’বছর হল, ওঁরা নিজেরাই দুর্গাপুজো করছেন। অন্য মণ্ডপে আর যান না। আলো হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘দেখো, যে ঘরের মাটি না পেলে দুর্গামূর্তি তৈরি হয় না, সে ঘরের মেয়েদেরই ঢুকতে দেওয়া হয় না পুজোমণ্ডপে।’’ ওঁদের তাই এখন আলাদা পুজো।

তবে আলো এমন দিনের স্বপ্ন দেখেন, যখন ‘সর্বজনীন’ পুজোয় আর পাঁচটা মেয়ের মতো ওঁদের অঞ্জলি দেওয়ার অধিকার থাকবে। নিজেদের কালী-দুর্গা ভাবতে চান না ওঁরা। চান মানুষের স্বীকৃতি। আজ কোনও যৌনকর্মীকে অ্যাসিড ছোড়া হলে প্রতিবাদে দেশ জেগে উঠত কি না, নিশ্চিত নন আলো। তবে বিশ্বাস করেন, সমাজ বদলাচ্ছে। এক দিন ওঁদের নিরাপত্তার অধিকার নিয়ে চিৎকার হবে, প্রচণ্ড চিৎকার। সে দিন কুঁচকে যাওয়া পোড়া চামড়ার যন্ত্রণা মিটবে আলোর।

এই বিশ্বাস আঁকড়ে আলো এক চিলতে ঘরে ফের কাপড় গোছাতে শুরু করেন। বিছানা ঝাড়েন। রান্নার বাসন মুছে তুলে রাখেন।

বাইরে পুজোর সন্ধ্যা নামে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Acid Attack Victim Acid Attack Survivor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE