পৃথিবী যখন কোয়রান্টিনে ঘরবন্দি, আমরা ১৪ জন নাবিক তখন কোভিড-লকডাউন- সামাজিক দূরত্বের বিধি নিষেধ থেকে অনেক দূরে অচেনা এক দেশের একটি ছোট্ট গেস্ট হাউসে বন্দি হয়ে কাটিয়ে দিলাম দশটা মাস। টেরও পেলাম না কখন শুরু হল লকডাউন কখনই বা সেই স্তব্ধ দশা ঘুচে শুরু হয়ে গেছে আনলক পর্ব! খান দুয়েক জানলা, আর এক ফালি বারান্দা— এই এক টুকরো পরিসরে মধ্য প্রাচ্যের ইয়েমেনের এক প্রান্তিক শহরে দশ মাসের নিবিড় বন্দি জীবন কাটল আমাদের। অপরাধ, ঝড়ের ধাক্কায় দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে আমাদের জাহাজ ভিড়েছিল ইয়েমেনের উপকূলে। তারই খেসারত গুনতে হল আমাদের। কান্দির তালগ্রামে আমাদের ছোট্ট গাঁয়ের বাড়ি, মায়ের মুখ, উঠোনের কদম গাছ— এক সময়ে সবই ফিকে হয়ে এসেছিল। ভাবতাম, আর কোনও দিন এ সবের সঙ্গে দেখা হবে না। নভেম্বরের শেষে মুক্তি পাওয়ার পরে রবিবার মুম্বই বিমান বন্দরে পা দিয়ে টের পেলাম, দেশের মায়া কি প্রবল। কেন এমন হল, ঘটনাটা একটু খুলে বলি।
গত ফেব্রুয়ারিতে তিনটি খালি জাহাজ নিয়ে আমরা ওমান থেকে সৌদি আরবের দিকে পাড়ি দিয়েছিলাম। কিন্তু ভেসে পড়ার পরের দুপুরেই উঠল প্রবল ঝড়। আমরা তখন আদেন উপসাগরে। চোখের সামনেই মোচার খোলার মতো উল্টে গেল একটি জাহাজ। নাবিকদের উদ্ধার করে আমরা ভোরের দিকে ডাঙা খুঁজে পেলাম। কিন্তু মাটি ছোঁয়ার আনন্দ ছিনিয়ে নিল ইয়েমেনের উপকূলরক্ষী বাহিনী ‘হুতি’। আমাদের আটক করা হল। পাসপোর্ট, নথিপত্র সব ভেসে গিয়েছে সমুদ্রে। জাহাজডুবির কথা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। জানালাম আমরা সৌদি আরবের ইয়ামবা বন্দরে যেতে চাই। শুনে ইয়েমেন কর্তৃপক্ষ আমাদের ঠাওরে বসল গুপ্তচর। সবাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হল ইয়েমেনের রাজধানী সানাতে। তার পর এক চিলতে একটি গেস্ট হাউসে আমাদের ঢুকিয়ে দিল তারা, শুরু হল বন্দি দশা। মাসের পর মাস পেরতে থাকল, মুক্তির নামগন্ধ নেই। ভাষা সমস্যায় আমরা বোঝাতেও পারছিলাম না আমাদের দুর্গতির কথা। ইয়েমেনে ভারতীয় দূতাবাস নেই। আমাদের জাহাজ সংস্থা শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ করে পড়শি দেশ জিবুতির ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পরে হাইকমিশনের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত সেই দু’কামরার গেস্ট হাউস থেকে মুক্তির পরে রবিবার আমরা দুবাই হয়ে মুম্বই পৌঁছিয়েছি।
(লেখক আটক নাবিক, মুর্শিদাবাদের তালগ্রামের বাসিন্দা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy