Advertisement
E-Paper

‘দানা’, ‘লকড়ি’র দাপটে চলে এলাকা-শাসন

বিরোধীদের দাবি, অন্তত গোটা দশেক ‘গ্যাং’ রয়েছে চোপড়ায়। তাদের কাজ এলাকায় কার সঙ্গে কার সম্পর্ক রয়েছে, তা বৈধ না বিবাহ বহির্ভূত, সে সব খোঁজ নেওয়া।

চোপড়ার ভাইরাল সেই ছবি।

চোপড়ার ভাইরাল সেই ছবি। —ফাইল চিত্র।

সৌমিত্র কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৪ ০৫:৫৮
Share
Save

শুধু মারের ভয়ই নয়, তার সঙ্গে ‘বন্দুকের শাসন’। “গুলি-বন্দুকের কমতি নেই চোপড়ায়’’, দাবি চোপড়া ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি মহম্মদ মসিরুদ্দিনের। কংগ্রেস নেতার মোবাইলের পর্দায় জোড়া বন্দুক হাতে গির আলমের ছবি (সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার)। চোপড়া-কাণ্ডে ধৃত তাজিমুল ইসলাম ওরফে জেসিবির ছায়াসঙ্গী তথা আত্মীয়। মসিরুদ্দিনের দাবি, চোপড়ায় যুবক-যুবতীকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ফেলে মারধরের ভিডিয়ো (আনন্দবাজার সত্যতা যাচাই করেনি) সমাজমাধ্যমে ছড়ানোর অনেক আগে থেকে জেসিবি এবং গির আলমেরা এই বন্দুকের ভয় দেখিয়ে এলাকাবাসীকে চুপ করিয়ে রেখেছে।
চোপড়ার পূর্বে বাংলাদেশ সীমান্ত, পশ্চিমে বিহার। নেপাল সীমান্তও বেশি দূরে নয়। স্থানীয় সূত্রের খবর, বিহারের মুঙ্গেরে তৈরি দেশি অস্ত্র এবং নেপাল থেকে ঘুরপথে বিহারে ঢোকা ভিন্‌দেশি আগ্নেয়াস্ত্র চোপড়ায় মেলে সহজে। কারবারিদের সঙ্কেতে বন্দুকের নাম ‘লকড়ি’, ‘দ্বিঘান লকড়ি’ অর্থাৎ, দোনলা বন্দুক। গুলি হয়েছে ‘দানা’ বা ‘বিচি’। দেশি পিস্তলের দাম ১০-১৫ হাজার টাকা। বিদেশি পিস্তলের দাম দু’লক্ষ টাকার কাছাকাছি। সিপিএমের উত্তর দিনাজপুর জেলা সম্পাদক আনোয়ারুল হকের দাবি, ‘‘অনেক দিন ধরেই এ সব কারবার চলছে। ভোটের সময় তা নিয়ে দাদাগিরি চলে। অন্য সময় বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্র দেখিয়ে এলাকায় দাপায় দুষ্কৃতীদের অনেকগুলো গ্যাং (দল)।’’

বিরোধীদের দাবি, অন্তত গোটা দশেক ‘গ্যাং’ রয়েছে চোপড়ায়। তাদের কাজ এলাকায় কার সঙ্গে কার সম্পর্ক রয়েছে, তা বৈধ না বিবাহ বহির্ভূত, সে সব খোঁজ নেওয়া। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক যাঁদের রয়েছে, তাঁদের বন্দুক দেখিয়ে তুলে এনে নিজেরাই সালিশিসভা বসিয়ে বহু লক্ষ টাকার ‘জরিমানা’ করা। জরিমানা দিতে পারলে ভাল। না হলে, প্রকাশ্যে মারধর করা হয়। শেষ পর্যন্ত প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়।

জুন মাসের মাঝামাঝি এক দিন গভীর রাতে এলাকার বাসিন্দা এক বিবাহিত যুবক ও তাঁর প্রেমিকাকে বন্দুক দেখিয়ে ডাঙাপাড়ার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় জেসিবি এবং তার শাগরেদরা, স্থানীয় সূত্রের দাবি। অভিযোগ, যুগলের হাতে, কোমরে, গলায় দড়ি বেঁধে, চড়-থাপ্পড় আর পিঠে ছড়ি দিয়ে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রকাশ্যে মারধর চলে রাতভর। তার পরে দু’দিন আটকে রাখা হয়। মহিলা সংজ্ঞা হারালে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হুঁশ ফেরানো হচ্ছে এমন ভিডিয়ো (সত্যতাযাচাই করেনি আনন্দবাজার) দেখে চমকে যান এলাকাবাসী। এই অত্যাচারের পরে, তাঁদের আট লক্ষ টাকা দিতে চাপ দেয় জেসিবিরা। এলাকায় যাওয়া কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিদের কাছে সে কথা জানিয়েছেন, দাবি ‘নিগৃহীত’ যুবকের। পরে, পুলিশের কাছেও অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি। কংগ্রেস নেতা মসিরুদ্দিনের দাবি, ‘‘সম্প্রতি ঘিন্নিগাঁও পঞ্চায়েতের আসারুবস্তিতে আর এক দল দুষ্কৃতী এক যুগলকে মারধর করে তুলে আনার চেষ্টা করে। তবে পরিবারের লোকেরা পাল্টা রুখে দাঁড়ানোয়, সুবিধা করতে পারেনি।’’ এলাকা সূত্রের খবর, ‘বিবাহবহির্ভূত’ সম্পর্কে জড়িয়ে মার খেয়েছে খোদ জেসিবিও। তবে সুস্থ হতেই ফের শুরু হয় ‘অত্যাচার’।

দুষ্কৃতীরা দমে না। কারণ, শুধু মারধর করে তোলাবাজি তাদের আয়ের এক মাত্র উপায় নয়। স্থানীয় সূত্রের খবর, গরু পাচারের কারবারে ‘মদত’, ‘অপহরণের’ মতো আয়ের উৎস রয়েছে তাদের। রয়েছে বিত্তশালী পুরুষকে চিহ্নিত করে তাঁকে ‘হানি-ট্র্যাপ’-এ ফেলার কারবার। স্থানীয় সূত্রের খবর, হুলাসুগছের এক ব্যক্তিকে সম্প্রতি আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে অপহরণ করা হয়েছিল। পরিবারের কাছে পাঁচ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছিল। ওই ব্যক্তির দাবি, ‘‘লাখ দুই টাকা দিয়ে ছাড় পেয়েছি। পুলিশের কাছে অভিযোগ করিনি। কারণ, ওরা এলাকাতেই আছে।’’ ইসলামপুর পুলিশ-জেলার সুপার জবি টমাস বলেন, ‘‘অভিযোগ পেলে,ব্যবস্থা নেব।’’

অভিযোগ আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে কংগ্রেসের নেতা মসিরুদ্দিন, সিপিএমের নেতা আনোয়ারুলের। তাঁদের দাবি, চোপড়ায় দাপিয়ে বেড়ানো সব ‘গ্যাং’ তৃণমূলের নেতাদের ‘ঘনিষ্ঠ’। জেসিবি তথা তাজিমুল ইসলাম তৃণমূলের লক্ষ্মীপুর অঞ্চল কমিটির চেয়ারম্যান। চোপড়া তৃণমূল ব্লক কংগ্রেসের সহসভাপতি জাকির আবেদিনের অবশ্য দাবি, ‘‘তাজিমুল দলে কোনও গুরু দায়িত্বে নেই। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’

তবে তৃণমূলের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের যোগাযোগের অভিযোগ ওঠা বন্ধ হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার হয়েছে আব্দুল খালেক। তার বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে টাকা তোলা, জমি দখল, মারপিট, খুনের চেষ্টা, মহিলাদের সম্মানহানির মতো অভিযোগ রয়েছে। আব্দুল খালেক চোপড়া বিধানসভার কমলাগাঁও-সুজালি অঞ্চলে তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি আব্দুল হকের ভাই। আব্দুল হক এবং জেসিবি-কে এক সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে দেখা যেত। এলাকার অনেকে আব্দুল হককে ‘ডন নম্বর ওয়ান’ এবং জেসিবি-কে ‘ডন নম্বর টু’ বলে ডাকতে অভ্যস্ত। জবরদখল-সহ নানা অনৈতিককাজের অভিযোগ ওঠায়, মাস ছয়েক আগে আব্দুল হক গা ঢাকা দেয়। এ বিষয়ে আবদুল হকের স্ত্রী কমলাগাঁও-সুজালি গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান নুরি বেগম বলেন, ‘‘শুধু অভিযোগ করলেই হল না। প্রমাণ দিতে হবে।’’

এই পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীর সহায় হতে পারত পুলিশ। কিন্তু তাদের ভূমিকায় বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। পুলিশ সুপার জবি টমাস বলেন, ‘‘জেসিবি-সহ চার জনকে ইতিমধ্যেই ধরা হয়েছে। বাকিদের খোঁজা হচ্ছে। আর কোথাও, কোনও অভিযোগ থাকলে, পুলিশ তা দেখছে।’’ তাঁর দাবি, মানুষের ভয় কাটাতে এলাকায় শিবির করার কথাও ভাবছে পুলিশ।

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Chopra TMC Crime

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}