Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

কৌটো ঘিরে বোমাতঙ্ক, দিব্যি নেড়েচেড়ে দেখলেন পুরপ্রধান

ছোট্ট একটা কৌটো। তার উপরে সবুজ টেপ দিয়ে লাগানো বড়সড় একখানা ব্যাটারি। তারের একটা অংশ বেরিয়ে আছে কৌটোর মধ্যে থেকে। জঙ্গলমহল নয়, খাগড়াগড়ও নয়। কিন্তু অশোকনগরের কচুয়া মোড় থেকে দিঘিরহাট যাওয়ার রাস্তায় নির্মীয়মাণ একটি সেতুর কাছে সন্দেহজনক বস্তুটি পড়ে থাকতে দেখে নিমেষে বোমাতঙ্ক ছড়ায় এলাকায়। শুক্রবার সকাল তখন প্রায় সাড়ে ৭টা।

ও কিছু হবে না...। শুক্রবার এমনই ভূমিকায় দেখা গেল সমীর দত্তকে। শান্তনু হালদারের তোলা ছবি।

ও কিছু হবে না...। শুক্রবার এমনই ভূমিকায় দেখা গেল সমীর দত্তকে। শান্তনু হালদারের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
অশোকনগর শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০২:০২
Share: Save:

ছোট্ট একটা কৌটো। তার উপরে সবুজ টেপ দিয়ে লাগানো বড়সড় একখানা ব্যাটারি। তারের একটা অংশ বেরিয়ে আছে কৌটোর মধ্যে থেকে।

জঙ্গলমহল নয়, খাগড়াগড়ও নয়। কিন্তু অশোকনগরের কচুয়া মোড় থেকে দিঘিরহাট যাওয়ার রাস্তায় নির্মীয়মাণ একটি সেতুর কাছে সন্দেহজনক বস্তুটি পড়ে থাকতে দেখে নিমেষে বোমাতঙ্ক ছড়ায় এলাকায়। শুক্রবার সকাল তখন প্রায় সাড়ে ৭টা। খবর ছড়িয়ে পড়তেই পিল পিল করে লোক জড়ো হতে থাকে। পুলিশ আসে, বম্ব স্কোয়াড আসে। চলে আসেন অশোকনগর-কল্যাণগড়ের পুরপ্রধান সমীর দত্ত। পুলিশের ব্যারিকেডের মধ্যে ঢুকে সন্দেহজনক কৌটোর দিকে এগিয়ে যান ‘অসমসাহসী’ পুরপ্রধান। রে রে করে ওঠেন পুলিশ কর্মীরা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাঁশ দিয়ে কৌটোয় খোঁচা মারেন পুরপ্রধান। চোখের পলক ফেলতেই কৌটো তুলে ছুঁড়ে ফেলে দেন পাশের ঝোপে।

কৌটো থেকে শেষমেশ বেরিয়েছে ধুলোবালি। কৌটোর পাশে যে ‘হুমকি চিঠি’ মিলেছে, তাকেও খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনছেন না পুলিশ কর্তারা। কিন্তু পুরপ্রধানের ‘সাহসিকতা’র কাহিনী শোরগোল ফেলেছে এলাকায়। কেন?

কৌটো বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে এর আগে একাধিক বার বড়সড় বিপদ ঘটেছে এ রাজ্যেরই নানা প্রান্তে। ২০০৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। জঙ্গলমহলে তখন মাওবাদীদের রমরমা। জঙ্গলে কৌটো বোমা পড়ে আছে খবর পেয়ে পৌঁছয় পুলিশ। সঙ্গে আবার ঘটা করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় সাংবাদিকদের। কেরামতি দেখাতে গিয়ে সে দিন ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে কৌটো খুলতে বসেছিলেন বম্ব স্কোয়াডের এক কর্মী। বিস্ফোরণে প্রাণ যায় উৎপল ভক্ত নামে বম্ব স্কোয়াডের ওই কর্মীর। মারা যান জেলা পুলিশ কর্মী বাসুদেব চক্রবর্তীর। জখম হন পুলিশ, আলোকচিত্রী, সাংবাদিক-সহ ২৯ জন। আনন্দবাজারের চিত্র সাংবাদিক সৌমেশ্বর মণ্ডলের একটি চোখ চিরকালের মতো নষ্ট হয়েছে ওই ঘটনায়। ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা প্রবল ভাবে সমালোচিত হয়েছিল গোটা রাজ্য জুড়ে। কেন অবিবেচকের মতো এমন কাণ্ড করলেন এক জন বম্ব স্কোয়াডের কর্মী, তার কোনও সদুত্তর জোগায়নি পুলিশ কর্তাদের মুখেও।

কিন্তু তারপরেও ঘটনাপ্রবাহ থেমে নেই। ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়ায় বিস্ফোরক উদ্ধার করে জিপে তুলে থানা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ফের সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ। ২০১৩ সালের ২৯ অগস্ট ভোর ৪টে নাগাদ টহল দিতে গিয়ে আলিপুরদুয়ার চৌপথিতে একটি বাজারের ব্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ। ব্যাগটি একটি লম্বা বাঁশের আগায় ঝুলিয়ে আলিপুরদুয়ার বিএম ক্লাব মাঠে রাখে পুলিশ। সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ শিলিগুড়ি থেকে বম্ব স্কোয়াড পৌঁছয়। কোনও রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই বম্ব স্কোয়াডের কর্মীরা টিফিন বক্সটি পরীক্ষা করেন। তার কিছু ক্ষণ পরেই সকাল সওয়া ১০টা নাগাদ বম্ব স্কোয়াডের কর্মী লালবাহাদুর লোহার বম্ব স্যুট ছাড়াই ব্যাগটির কাছে একা এগিয়ে যান। ঝুঁকে ব্যাগটি দেখতে যাওয়ার মুহূর্তেই বিস্ফোরণ হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ৪৮ বছরের লালবাহাদুর লোহারের।

সে বারও চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছিল পুলিশ। কার্যত মৃত্যু ডেকে এনেছিল। শুক্রবার সকালে বীরত্ব দেখাতে গিয়ে সমীরবাবু যা করেছেন, তা-ও একই ভাবে সমালোচিত হচ্ছে নানা মহলে। জেলা পুলিশের একাংশের বক্তব্য, “বিস্ফোরক ছিল না, তাই বড় কোনও বিপদ ঘটেনি। কিন্তু যদি কৌটো ফাটত, তার দায় তো পুলিশের ঘাড়ে এসেই পড়ত।” এক পুলিশ কর্তার কথায়, “ওঁকে বারণ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, বম্ব স্কোয়াড বিষয়টি দেখছে। আপনি বাঁশ দিয়ে খোঁচাবেন না। কিন্তু উনি সে কথায় কান দিলেন না। এমনকী, কৌটো হাতে তুলে ছুড়ে ফেললেন। বম্ব স্কোয়াডের লোকজন তো ঝোপের মধ্যে থেকে কৌটো উদ্ধার করে সেটি খুলেছে।”

আর কী বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা?

এলাকার এক বৃদ্ধের কথায়, “সমীরবাবু হঠাৎ ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন। পুলিশ ওঁকে কাছে যেতে বারণ করেছিল। কিন্তু সে সবে কর্ণপাত করেননি উনি। কৌটোও ছুড়ে ফেলেন। এ সব কী ব্যাপার-স্যাপার!” আর এক যুবকের কথায়, “পুলিশ আমাদের বার বার সাবধান করছিল। ব্যারিকেড করে ঘিরে রেখেছিল জায়গাটা। কিন্তু পুরপ্রধানের মতো এমন এক জন হর্তাকর্তাই যদি এমন অবিবেচকের মতো কাজ করেন, তা হলে সাধারণ লোক কী বুঝবে?” প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সত্যসেবী করও এই সুযোগে খোঁচা দিতে ছাড়েননি তৃণমূলের পুরপ্রধানকে। তিনি বলেন, “চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। সমীরবাবু কি নিশ্চিত ছিলেন, ওটা বোমা হবে না?” তাঁর প্রশ্ন, “এত আত্মবিশ্বাস উনি পেলেন কী করে?”

২২ সেপ্টেম্বর, ২০০৬। ঝিটকার জঙ্গলে
বিস্ফোরণের ঠিক আগে। ফাইল চিত্র।

এত সবের পরেও অবশ্য হেলদোল নেই সমীরবাবুর। কেন করলেন এমন কাণ্ড? নিজের হাতে কৌটো তুলে ঝোপে ছুড়ে ফেলেছেন, তা অবশ্য মানতে চাননি তিনি। সমীরবাবুর যুক্তি, “এলাকার মানুষই কৌটো ছুড়ে ফেলেন।” কিন্তু এই যে বাঁশ দিয়ে কৌটো নাড়ালেন, কাছে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন? পাশ কাটিয়ে সমীরবাবুর জবাব, “এলাকায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে বিরোধীরা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।” কিন্তু সাবধানতার প্রশ্নের কী হবে? নিরুত্তর পুরপ্রধান। কিছু লোক অবশ্য তাঁর সাহস দেখে মুগ্ধ।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, কচুয়ামোড় থেকে দিঘিরহাট যাওয়ার পথে বিদ্যাধরী খালের উপরে একটি কাঠের সাঁকো ছিল। ২০১০ সালে পাথর-বোঝাই একটি ভারি ট্রাক তাতে উঠতে গেলে সাঁকো ভেঙে পড়ে। পরে সেটি পাকা করার পরিকল্পনা করা হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ২৫ মিটার কংক্রিটের সেতুটির ওয়ার্ক অর্ডার হয়। কাজ শুরু হলেও তা শেষ হয়নি। এলাকার মানুষজনকে ঘুরপথে যাতায়াত করতে হচ্ছে। তা নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ আছে এলাকায়।

এ দিন কৌটোর পাশে হাতে লেখা একটি পোস্টার পড়ে ছিল। তাতে সিপিআইএমএল-এর নামে লেখা, পনেরো দিনের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করতে না পারলে বোমা মেরে সেতু উড়িয়ে দেওয়া হবে। পুলিশ পোস্টারটিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, এলাকার কেউ মশকরা করে এমন কাজ করে থাকবে। তবে কাজটি করেছে রীতিমতো ভেবেচিন্তে, গুছিয়ে। ঘটনাটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না সিপিআইএমএল-ও। দলের অশোকনগর লোকাল কমিটির সম্পাদক অজয় বসাক বলেন, “আমরা যে কোনও ধরনের নাশকতা বা তার চেষ্টার নিন্দা করছি। এটা আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত।”

কিন্তু সেতুর কাজ সত্যি কবে শেষ হবে, এ দিন তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দানা বেঁধেছে বাসিন্দাদের মধ্যে। পূর্ত (সড়ক) দফতরের সহকারী বাস্তুকার (হাবরা হাইওয়ে সাব ডিভিশন) গৌতম পাল বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। তারপরে সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।”

অন্য বিষয়গুলি:

ashaknagar bomb
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy