শহুরে উচ্চকোটির ইফতার-পার্টির পাশে হয়তো নিতান্তই
সাদামাটা। কানাওয়ালা থালায় কিছু খেজুর, মুঠো মুঠো মুড়ি, ভেজানো ছোলা আর টুকরো করে কাটা শসা, শাঁকালু, আপেল, আঙুর ঘিরে বসেছেন রোজাদার শ্রমিক মহিলারা। তাঁদের উপবাস ভঙ্গের তদারকিতে কারখানার সহকর্মী ভিন্ধর্মী শ্রমিক বোনেদের দল। রমজানি সাঁঝে এমন ইফতার কদাচ দেখা যায় কলকাতায়। খেটে খাওয়া মেয়েদের বোনতুতো বাঁধনের গলাগলিতে যা এক ধরনের যুদ্ধজয়ের আনন্দও মিশিয়ে দিল।
শহরের উপকণ্ঠে সোনারপুর থানা এলাকার একটি বস্ত্র কারখানার শ্রমিক মেয়েদের জন্য সোমবার দিনটা ছিল সত্যিই অন্য রকম। তাঁদের পিএফ বা ভবিষ্যনিধির টাকায়
মালিকপক্ষের কারচুপির অভিযোগে শ্রমিক আন্দোলন চলছিল মাসখানেকের কাছাকাছি। কাজ বন্ধ রেখে পালা করে কারখানার গেটে অবস্থানে বসেন কয়েকশো মহিলা শ্রমিক। রোজার মাসে
মুসলিম বোনেরা লড়াই ছাড়েননি। হিন্দু বোনেরাও তাঁদের পাশে ছিলেন নাগাড়ে। দীর্ঘ আন্দোলন শেষে মালিকপক্ষ অবশেষে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়েছেন বলে এ
দিন সাফিয়া খাতুন, মামণি পোদ্দার, মৌমিতা মণ্ডল, বেবি বিবিরা জানিয়েছেন।
তাঁদের অভিযোগ, ২০১১ সালে তৈরি কারখানায় দীর্ঘ দিন ধরেই পিএফের টাকা প্রায় অর্ধেক কম জমা পড়ছিল। একটি অন্য ভাতা
খাতে কিছু টাকা দেখিয়ে মাইনের ‘বেসিকের’ ভাগ সবার অজানতে কমিয়ে দেন মালিকপক্ষ। ফলে পিএফের ভাগে টাকা কম হচ্ছিল। কারখানার কর্ণধার অনিল বাগাড়িয়ার সঙ্গে সোনারপুর থানায় এ দিন বিষয়টির লিখিত ভাবে মিটমাট হয়। শ্রমিকদের দাবি, বকেয়া পিএফ এ বছরের মধ্যে মিটিয়ে দেবেন বলেছেন মালিক। অনিল বাগাড়িয়া বলেন, “পুলিশের উপস্থিতিতে মিটমাট হয়েছে। কী শর্ত, সে সব আমাদের ভিতরের ব্যাপার।”
আজ, মঙ্গলবার শ্রমিকেরা কাজে ফিরছেন বলে সব পক্ষই জানায়। ৭০০ জন মহিলা
শ্রমিকের কারখানায় হাতে হাতে খুব দ্রুত গেঞ্জি, প্যান্ট তৈরির নির্দিষ্ট পদ্ধতি চালু ছিল। অনেক সময়ে শ্রমিকেরা শৌচাগারে গেলেও সমস্যা হত বলে অভিযোগ। কাপড় নাম্বারিংয়ে যুক্ত টুম্পা মিশ্র, মেশিন বিভাগের
মৌমিতা মণ্ডলেরা বলছিলেন, “রোজার মাসটা মুসলিম বোনেদের খুব কষ্ট যায়! জল পর্যন্ত না খেয়ে জোরে কাজ টানতে কষ্ট হত ওদের। এ সব অনেক দিন
দেখছি, তাই এ বছর আন্দোলন চলতে চলতেই মাথায় আসে, আমরা এক দিন ওদের ইফতার করাব।” মেয়েরা জানাচ্ছেন, যে যা পারেন ৩০ টাকা, ৫০ টাকা জড়ো করেছেন। তাতেই ফল, বেগুনি, চপ, পেঁয়াজির ব্যবস্থা হয়েছে। বোনেরা গলা ভেজাবে কিসে! ভাবতে ভাবতে কেনা হয়েছে ফলের রসের বোতলও।
এ দিন দুপুর থেকেই কাটাকুটির কাজে হিন্দু, মুসলিম সব মেয়েরা একজোট হন। থানায় মালিকের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন কয়েক জন। আসুরা বিবি, সাবিরা বিবিরা বলছিলেন, “মেয়েদের মধ্যে এখানে হিন্দু, মুসলিম ভাগ নেই। কারখানায় বিশ্বকর্মা পুজোয় হিন্দু মেয়েরা পুজোর কাজ করে, আমরা তখনও ফলটল কাটি। আবার ইদে হিন্দু মেয়েরা আমাদের ঘরে সিমুই খেতে আসে!”
ঘটনাচক্রে আন্দোলনে যুদ্ধজয়ের দিনটা মিলে গিয়েছে ইফতারের সঙ্গে। ইফতারের পরে
আবির খেলা, গানবাজনাও করেন মেয়েরা। সবাইকে সবার আরও কাছে মিলিয়ে দিল এক সঙ্গে সান্ধ্য উপোস ভাঙার এই আসর।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)