Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Trafficking

পাচার রুখতে কাজ করছে ফিরে আসা মেয়ের দল

পুলিশ ও এক ব্যক্তির সাহায্যে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা হয় ওই কিশোরীকে। বছর ছ’য়েক পরে বাড়ি ফেরে। এখন তিনি তরুণী। জানালেন, বাড়ি ফিরে সামাজিক নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল।

আলোচনা শিবিরে উপস্থিত পাচার থেকে ফিরে আসা মেয়েরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

আলোচনা শিবিরে উপস্থিত পাচার থেকে ফিরে আসা মেয়েরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২০ ০১:৪৭
Share: Save:

হাবড়ার তেরো বছরের এক কিশোরীকে পাশের বাড়ির ‘দাদা’ নিজের শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবে বলে ডেকে নেয়। সন্ধ্যায় মেয়েটি জানতে পারে, সে বর্ধমান স্টেশনে। জলের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে তাকে খাইয়ে দিয়েছিল ওই ‘দাদা।’ তাকে বিক্রি করা হয়েছিল মুম্বইয়ের এক যৌনপল্লিতে।

পুলিশ ও এক ব্যক্তির সাহায্যে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা হয় ওই কিশোরীকে। বছর ছ’য়েক পরে বাড়ি ফেরে। এখন তিনি তরুণী। জানালেন, বাড়ি ফিরে সামাজিক নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। পাড়া-পড়শিরা দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। রাস্তার বেরোলে শুনতে হত কটূক্তি। কিন্তু ভেঙে পড়েননি তিনি। পরে বিয়ে হয়। দু’টি সন্তান রয়েছে। তবু এখনও শুনতে হয় বাঁকা কথা। তরুণীর কথায়, ‘‘আমি ভাবতেই পারিনি, এত পরিচিত দাদা এমন ঘটনা ঘটাতে পারে আমার সঙ্গে।’’ তরুণীর আফসোস, ‘‘ওই লোকের আজও কোনও শাস্তি হয়নি।’’

বাগদার এক তরুণীর বিয়ে হয়েছিল মধ্যমগ্রামে। তাঁর স্বামী যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেয়। স্বামীর সাজা হয়নি। উল্টে এখনও সে হুমকি দিচ্ছে। তরুণী এখন বাগদায় বাপের বাড়িতে থাকেন। তাঁকেও শুনতে হয় কটূক্তি, উড়ো মন্তব্য।

পাচারের পরে ফিরে আসা মেয়েরা যাতে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন, সে জন্য বেশ কিছু তরুণী সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন। সামাজিক ও আইনি অধিকার রক্ষা ও সামাজিক সম্মান ফিরে পেতে কাজ করছেন তাঁরা। পাটনার্স ফর অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং নামে একটি সংগঠনও তৈরি করেছেন। ওই সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৬ সালের পরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় প্রায় ১৫০ জন পাচার হওয়া মেয়েকে তাঁরা দিল্লি, মুম্বই নেপাল, কলকাতা থেকে উদ্ধার করে এনেছেন।

বুধবার বনগাঁর কুঠিবাড়ি এলাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে পাচার হয়ে ফিরে আসা সেই মেয়েরাই কয়েজন শোনালেন জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। এ দিন বনগাঁ, গাইঘাটা, বাগদা, হাবড়া, বারাসত থেকে পাচারের পরে ফিরে আসা ৩৫ জন মেয়ে এসেছিলেন। অনেকে আতঙ্কের সেই সব দিনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তাঁদের কথায়, ‘‘আমাদের জীবনে যা ঘটেছে, তা যেন আর কোনও মেয়ের জীবনে না ঘটে।’’

পাচার হওয়া মেয়েরা এ দিন জানালেন, যাঁরা তাঁদের পাচার করে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের অনেকেরই শাস্তি হয়নি। এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। আর তাঁদের সমাজে ভয়ে মুখ লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। পাচার হওয়া এক তরুণীর কথায়, ‘‘আমাকে যে যৌনপল্লিতে বিক্রি করেছিল, তার কোনও শাস্তি হয়নি। উল্টে আমি বাড়ি ফিরে আসার পরে আমাকে ও আমার পরিবারের লোকজনকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি ওর শাস্তির জন্য।’’জানা গেল, কোনও মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে পাচার করা হয়েছিল। কারও আবার আত্মীয়েরাই টাকার জন্য বিক্রি করে দিয়েছিল যৌনপল্লিতে। বিয়ের পরে অনেক তরুণীকে স্বামীরাই পাচার করেছে—এমন ঘটনাও ঘটেছে। কাজের প্রলোভন দেখিয়ে অনেক মেয়েকে পাচার করা হয়।

পাচার হওয়া মেয়েরা পরামর্শ দিলেন, কোনও মেয়ে যেন অচেনা কারও প্রেমের ফাঁদে না পড়েন। ভাল করে খোঁজ-খবর না নিয়ে কেউ যেন কাজের জন্য কারও সঙ্গে বাড়ি থেকে চলে না যান। বিভিন্ন এলাকায় কর্মশালা করে মেয়েদের সচেতন করছেন এঁরা। পাচার হওয়া মেয়েদের উদ্ধারের কাজেও ভূমিকা নিচ্ছেন। পাচারের পরে ফিরে আসা মেয়েদের পুনর্বাসন, শারীরিক মানসিক চিকিৎসা, শিক্ষা, আইনি সাহায্য করছেন। পাশাপাশি পাচারকারীদের গ্রেফতার, শাস্তির দাবিতেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

সংগঠনের সদস্য শুভঙ্কর সরকার বলেন, ‘‘উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ১৮টি ব্লকে আমরা কাজ করছি। ওই জেলায় নারীপাচার একটা বড় সমস্যা। পাচার হয়ে ফিরে আসা মেয়েরা সব সময়ে আইনি সাহায্য পাচ্ছেন না। সামাজিক সম্মান হারাচ্ছেন। সরকার থেকেও তাঁদের সুযোগ-সুবিধা পেতে সমস্যা হয়। পাচার হওয়া মেয়েরাই এখন নিজেদের সম্মান, অধিকার বুঝে নিতে কাজ করছেন।’’ সংগঠনের দাবি, পাচার হয়ে ফিরে আসা মেয়েরা যাতে সরকারি ঋণ, ক্ষতিপূরণ পান, সে জন্য সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Trafficking Human Trafficking Bangaon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy