Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

প্রমীলা-হাতে ঢাকের বোল তুলিয়ে স্বপ্নপূরণ গোকুলের

শাঁখা-চুড়ি পরা হাতই এখন ঢ্যামকুড়াকুড় বোল ফোটাচ্ছে! গাছগাছালির ছায়াঘেরা বাড়ির উঠোনে সেই বোল শুনছেন গোকুল দাস। তালিমে টুকিটাকি ভুল শুধরে দিচ্ছেন। এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত তিনি। ছ’বছর আগে দেখা স্বপ্নটা ছুঁয়ে ফেলেছেন যে!

হাঁড়ি-হেঁসেল সামলানো হাতেও ঢাকের বোল। ছবি: শান্তনু হালদার।

হাঁড়ি-হেঁসেল সামলানো হাতেও ঢাকের বোল। ছবি: শান্তনু হালদার।

সীমান্ত মৈত্র
হাবরা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৪৬
Share: Save:

শাঁখা-চুড়ি পরা হাতই এখন ঢ্যামকুড়াকুড় বোল ফোটাচ্ছে!

গাছগাছালির ছায়াঘেরা বাড়ির উঠোনে সেই বোল শুনছেন গোকুল দাস। তালিমে টুকিটাকি ভুল শুধরে দিচ্ছেন। এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত তিনি। ছ’বছর আগে দেখা স্বপ্নটা ছুঁয়ে ফেলেছেন যে! ঢাক বাজিয়ে গ্রামের মহিলারা উপার্জন করছেন। শিল্পীর সম্মানও পাচ্ছেন।

ছ’বছর আগে ছ’জন মহিলাকে ঢাক বাজানো শেখাতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরের বিধান পল্লির বাসিন্দা গোকুলচন্দ্র দাসের। আর এখন তাঁর মহিলা-শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ ছুঁয়েছে! পুরুষ-শিক্ষার্থীরা তো আছেনই!

গ্রামের মহিলাদের ঢাক বাজানো শেখানোর ভাবনাটা গোকুলবাবুর মাথায় আসে এক মার্কিন মহিলাকে দেখে। সেটা ২০১০ সাল। ঢাকি হিসেবে ততদিনে নাম করে গিয়েছেন গোকুলবাবু। জাকির হোসেনের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়েছিলেন শো করতে। ফেরার আগে ছেলের জন্য স্যাক্সোফোন কিনতে ঢুকেছিলেন সেখানকার একটি দোকানে। এক মহিলাকে নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বিক্রি করতে দেখেন। তখনই গোকুলবাবুর মাথায় গ্রামের মহিলাদের ঢাক বাজানো শেখানোর ভাবনা আসে।

আর এখন পুজো এলেই তাঁর ছাত্রীদের কেউ ঢাক কাঁধে পাড়ি দেন দিল্লি, কেউ অসম, কেউ বা কলকাতা! দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় বছর পঞ্চাশের গোকুলবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘বেশ লাগে দেখতে। মহিলা-ঢাকিদের কদর বাড়ছে। এটাই তো চেয়েছিলাম। আমেরিকার মহিলা পারলে, আমার গ্রামের মেয়েরা কেন পারবে না?’’

ঢাকই ছেলেবেলা থেকে গোকুলবাবুর ধ্যানজ্ঞান। বাপ-ঠাকুর্দাও ঢাকি ছিলেন। চার বছর বয়সে গোকুলবাবুর ঢাকে হাতেখড়ি। ছ’বছর বয়সে কাকার কাঁধে চড়ে দুর্গাপুজোয় প্রথম ঢাক বাজান। পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত। আমেরিকা ছাড়াও তাঁর ঢাকের বোল শুনেছেন বাংলাদেশ, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা-সহ নানা দেশের শ্রোতারা। দেশের এমন কোনও বড় শহর নেই, যেখানে তিনি অনুষ্ঠান করেননি। ইংরেজি ‘দ্য ওয়েটিং সিটি’ এবং বাংলায় শতাব্দী রায় পরিচালিত ‘ঢাকি’ ছবিতে তিনি ঢাক বাজিয়েছেন। ‘ঢাকি’তে একটি ছোট চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছেন। বাউল গানও গাইতে পারেন। গোড়ার দিকে ঢাকি হিসেবে সে ভাবে সম্মান না-মেলায় অভিমানে কিছুদিন বাজানো বন্ধ রেখে শুধু গান গাইতেন। তার পরে ফের কাঁধে ঢাক তুলে নেন।

এ পর্যন্ত হলিউডে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে বাজানোটাই নিজের সবচেয়ে বড় সম্মান বলে মনে করেন গোকুলবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘বছর সাতেক আগে শো’টা হয়েছিল। হলে ১৮ হাজার শ্রোতা ছিলেন। আমার ঢাক শুনে পণ্ডিতজি বলেছিলেন, ‘আমাদের সব কম্পোজিশন গোকুল ঢাকের তালে ভাসিয়ে নিয়ে গেল’। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’’

এখনও নিজে বাজান গোকুলবাবু। কিন্তু তাঁর ‘পাখির চোখ’ গ্রামের মহিলাদের ঢাকি হিসেবে তৈরি করা। সারা বছরই তালিম দেন। পুজোর সময় এলে প্রশিক্ষণ-পর্ব দীর্ঘায়িত হয়। এ রাজ্যে এখন ঢাকিদের সুদিন ফিরছে বলে মনে করছেন গোকুলবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ঢাক এখন আর শুধু দুর্গাপুজোর অনুষঙ্গ নয়। দোকান বা শপিং মলের উদ্বোধনেও ঢাকিদের ডাক পড়ছে। মহিলা-ঢাকিদের কদর তো আরও বেশি।’’

গ্রামের আর পাঁচজন মেয়ে-বউয়ের সঙ্গে গোকুলবাবুর কাছে ঢাক বাজানোর তালিম নিচ্ছেন তাঁর পুত্রবধূ উমাদেবীও। তাঁর কথায়, ‘‘বাবার হাতে জাদু আছে। কত সহজে শিখিয়ে দেন। আমিও তো অনেক জায়গায় ইতিমধ্যে বাজিয়েছি।’’ আর গ্রামের প্রমীলা দাস, মৌমিতা দাসরা বলছেন, ‘‘কোনও দিন শিল্পী হব ভাবিনি। গোকুলবাবুর জন্যই সেই সম্মান পাচ্ছি। ঘরেও দু’টো পয়সা আসছে।’’

গোকুলবাবুর স্বপ্নপূরণ হয়েছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy