বাজিগর: বাজি বানাতে ব্যস্ত বলা (বাঁ দিকে)। নিজস্ব চিত্র
বছর দুই আগে বাজি তৈরির যে পেশা স্বামী ও ভাসুরের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, এখন পেটের টানে ও সন্তানদের মানুষ করার তাগিদে ঝুঁকির সেই কাজই আঁকড়ে ধরেছেন এক মহিলা। কারণ, রোজগারের অন্য কোনও পথ খোলা নেই তাঁর কাছে।
২০১৭ সালের ১৪ জুলাই। ওই দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটির কাঞ্চনমাঠ এলাকার গায়েনপাড়ায় বাড়ি লাগোয়া বাজি কারখানায় কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রদীপ মণ্ডল ও অশোক মণ্ডলের। বেলা ১২টা নাগাদ বিকট শব্দে ঘটেছিল বিস্ফোরণ। দুই ভাই পুরোপুরি ঝলসে গিয়েছিলেন। অশোক সেই অবস্থায় কারখানার পাশের পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। গুরুতর জখম অবস্থায় প্রদীপকে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। ঘটনার দিনই মৃত্যু হয় অশোকের। তিন দিন পরে মারা যান প্রদীপ। বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটি দরমার ঘরে বাজি তৈরি করতেন দুই ভাই। দু’জনেই হঠাৎ একসঙ্গে মারা যাওয়ায় সংসারে নেমে আসে ঘোর অনিশ্চয়তা। ঘটনার পরে প্রদীপের স্ত্রী শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যান। কিন্তু অশোকের স্ত্রী বলা থেকে যান ওই বাড়িতেই।
বলার কথায়, ‘‘ওই দিন কী ভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ফোরে পড়ে। মেয়ে সেভেনে। ওদের পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি সংসারটাও তো চালাতে হবে। আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। এই বাজারে আমি আর কত টাকা বেতনের চাকরি পাব বলতে পারেন? তা ছাড়া, চাকরি করতে গেলে তো দিনের ১২ ঘণ্টাই বাড়ির বাইরে কাটাতে হবে। ছেলেমেয়েকে দেখবে কে! আর খুব সামান্য টাকায় সংসার চলবেই বা কী ভাবে?’’
স্বামী ও ভাসুরের মৃত্যুর পরে ব্যবসার পুঁজি থেকেই শ্রমিকদের প্রায় তিন লক্ষ টাকা বকেয়া মজুরি মিটিয়েছেন বলা। তাঁর কথায়, ‘‘ওই ঘটনার পরে বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে বাজি বিক্রি বাবদ টাকা পেয়েছিলাম। বকেয়া মেটানোর পরে আমার হাতে ছিল মাত্র এক লক্ষ টাকা। ওই পুঁজি নিয়েই গত বছর কলকাতা ও আশপাশের কারখানা থেকে বাজি কিনে এনে বিক্রি করেছিলাম। কিন্তু লাভের মুখ দেখতে পাইনি। তার পরে ঠিক করি, নিজেই বাজি তৈরি করব।’’
বলা বলছেন, ‘‘আমাদের ওই কারখানায় কারিগরদের দিয়ে নানা ধরনের চরকি তৈরি করাচ্ছি। আমার স্বামী আতসবাজি তৈরি করত। আমি আপাতত শুধু চরকিই বানাচ্ছি।’’ এক দুপুরে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সঙ্গে দুই মহিলা শ্রমিককে নিয়ে একের পর এক কাগজের প্যাকেটে চরকি ভরছেন বলা। বাড়ির ভিতরে এক দিকে চরকির স্তূপ। অন্য দিকে থরে থরে সাজানো বাক্স ভর্তি চরকি।
বিস্ফোরণে স্বামী ও ভাসুরের মৃত্যুর পরেও বাড়ির ভিতরে বাজির গুদাম? এত ঝুঁকি নিচ্ছেন কী ভাবে? প্যাকেটে চরকি ভরতে ভরতে বলা বলেন, ‘‘বাড়ির কোথাও একটা দেশলাই কাঠিও রাখিনি। লোডশেডিং হয়ে গেলে ইনভার্টার চালাই। বাড়ির একেবারে পিছনে ছোট একটি ঘরে রান্না হয়। আমি নিজে কিন্তু রান্নাঘরে যাই না। কারণ, গায়ে-শাড়িতে বারুদ লেগে রয়েছে। বাড়িতে বারুদ উড়ছে। যখন-তখন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমার মা এখন এখানে। উনিই রান্না করেন।’’ এর পরে কিছুটা উদাস ভাবে বলা যোগ করেন, ‘‘যতটা সম্ভব সতর্ক থাকছি। এর পরে কিছু হলে ভগবান ভরসা। ছেলেমেয়েদের মা-ই দেখেন।’’
বলার মা জয়ন্তীদেবীর কথায়, ‘‘বাজি তৈরি করা ছাড়া আমার মেয়ের আর কোনও উপায় নেই। এক লক্ষ টাকা দিয়ে মুরগির খামার খোলার কথা অনেকে বলেছিল। কিন্তু ওই ব্যবসার কিছুই মেয়ে জানে না। লোকসানের আশঙ্কা ছিল। ওর স্বামীর ব্যবসার অনেক বাঁধা খদ্দের ছিল। সেই কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওকেও এই ব্যবসায় আসতে হল।’’ এর পরে বৃদ্ধা যোগ করেন, ‘‘ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক, এই তিন মাস আমি মেয়ের কাছেই থাকি। ও বাজি নিয়ে ব্যস্ত। আমি নাতি-নাতনি আর রান্না সামলাই। মেয়েটার জীবনটা তো আবার পথে আনতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy