প্রতীকী ছবি
রুজিতে টান পড়েছিল আগেই। এ বার করোনা মোকাবিলায় লকডাউন শুরু হতেই রুজিরোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার কয়েক হাজার গৃহশিক্ষকের। আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন তাঁরা। সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন।
সম্মানের কথা ভেবে অনেক শিক্ষকই বেসরকারি ভাবে দেওয়া ত্রাণের লাইনেও দাঁড়াতে পারছেন না। গৃহশিক্ষকদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা স্কুলের শিক্ষকশিক্ষিকাদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছেন। রাজ্যের শিক্ষা দফতরের নির্দেশ অমান্য করে স্কুলের কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রাইভেট টিউশন করাচ্ছিলেন। এতে এমনিতেই গৃহশিক্ষকদের রুজিতে টান পড়ছিল।
গৃহশিক্ষকদের বক্তব্য, তাঁরা কেউ অন্যের বাড়িতে গিয়ে বা নিজের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে সংসার চালান। লকডাউন শুরু হতেই ছাত্রছাত্রীরা বাড়ির থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছে। শিক্ষকদের বাড়িতে যাচ্ছে না। শিক্ষকেরাও বাড়িতে গিয়ে পড়াতে পারছেন না। অভিভাবকেরা গৃহশিক্ষকদের জানিয়ে দিয়েছেন, আপাতত তাঁরা যেন বাড়িতে আর পড়াতে না আসেন। গৃহশিক্ষকদের একটা বড় অংশ জানাচ্ছেন, মার্চ মাসের বেতন অনেকেই পেয়েছেন। কিন্তু এপ্রিল মাসে তাঁরা আর বেতন পাননি।
হাবড়ার গৃহশিক্ষক রবিন দাসের ছাত্র পড়ানো বন্ধ। তাঁর মা ক্যানসারে আক্রান্ত। কেমোথেরাপি চলছে। আর্থিক কারণে এখন তা বন্ধ করতে হয়েছে। পলাশ দাস নামে এক গৃহশিক্ষক বাড়িতে গিয়ে বা নিজের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। কিন্তু এখন সে সব বন্ধ। এপ্রিল মাস থেকে অভিভাবকেরাও অনেকে বেতন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি-সহ বিভিন্ন এলাকার গৃহশিক্ষকেরাও সমস্যায় পড়েছেন। গ্রামের অনেক যুবক স্নাতক হয়ে গৃহশিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ বিএড করেও স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ পাননি। তাঁরাও বাড়িতেই পড়ান। সেই রোজগারেই সংসার চলে। কারও বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। কারও আবার সন্তান ছোট। কিন্তু এপ্রিল মাস থেকে তাঁদের হাতে টাকা নেই।
হাসনাবাদ থানার বিশপুরের বাসিন্দা বরুণ মজুমদার বলেন, ‘‘গৃহশিক্ষকতা করে মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা আয় করতাম। আমিই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। বাড়িতে অসুস্থ ভাই ও মা রয়েছেন। মাসের শেষে যা টাকা পেতাম, তা দিয়ে কোনও মতে সংসার চলত। কিন্তু এখন হাতে একদম টাকা নেই।’’
রাজ্যে গৃহশিক্ষকদের সংগঠন, গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতি রয়েছে। সমিতির এক কর্তা বলেন, ‘‘গৃহশিক্ষকদের সকলেই এখন রুজিরোজগার হারিয়ে সঙ্কটে পড়েছেন। আমাদের পক্ষেও সমিতির সদস্যদের সাহায্য করা খুবই কষ্টসাধ্য।’’ সমিতির রাজ্য কমিটির সদস্য শুভ্র দাস বলেন, ‘‘আমি ৬০-৭০ জন ছাত্রছাত্রী পড়াতাম। এখন সব বন্ধ। মায়ের কার্ডিয়োগ্রাফি করানোর খুবই প্রয়োজন। তা সম্ভব হচ্ছে না।’’
বনগাঁর এক গৃহশিক্ষক পরিবারে চারজন সদস্য। তাঁকে অভিভাবকেরা বলে দিয়েছেন, আর বাড়িতে আসতে হবে না। খাদ্য সঙ্কটে পড়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘রেশন থেকে পাওয়া খাদ্য সামগ্রী দিয়ে আর কতদিন চলে। ত্রাণের জন্য কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারছি না।’’ গৃহশিক্ষকের এরই মধ্যে ক্ষুব্ধ। শুভ্র বলেন, ‘‘আমরা না খেয়ে মরছি। আর স্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ বেআইনি ভাবে অনলাইনে প্রাইভেট টিউশন করা শুরু করেছেন। সরকারের উচিত আমাদের পাশে দাঁড়ানো।’’
গৃহ শিক্ষকদের অসহায়তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতির টাকি হাসনাবাদ শাখার পক্ষ থেকে সৌরভ দাস বলেন, ‘‘অনেকেই খুব সামান্য টাকা উপার্জন করে গৃহশিক্ষকতা করেন। তা দিয়েই তাঁদের সংসার চলত। কিন্তু লকডাউন উঠলে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী গৃহশিক্ষকের কাছে আসবে না বলে আশঙ্কা আমাদের।’’ কারণ, নিম্নবিত্ত বহু পরিবারই লকডাউনের ডেরে তীব্র আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠে ছেলেমেয়েদের ক’জন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠাবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে।
গৃহশিক্ষকতা ছাড়াও হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি এলাকায় অনেকেই গান, নাচ ও আঁকা শিখিয়েও জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু এখন সব বন্ধ। তাই চিন্তায় কয়েক’শো পরিবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy