প্লাস্টিকের মধ্যেই জিনিসপত্র।
লকাডাউনের পর এক মাস কাটতে না কাটতেই সামনে এসেছিল এক অন্য সুন্দরবনের ছবি। পর্যটকহীন সেই সুন্দরবনে লঞ্চের দাপাদাপি ছিল না। খেয়া পারাপার ছিল না। সাউন্ডবক্স বাজিয়ে হুল্লোড় ছিল না। তার ফলে পরিযায়ী পাখিরা ফিরছিল, বসতির কাছাকাছি নদীতে ঘোরাঘুরি বাড়ছিল দেশি মাছেদের। দূষণ দূরে সরেছিল অনেকটাই। পর্যটকদের ফেলা আলুভাজা-আইসক্রিমের প্লাস্টিকও ধীরে ধীরে অতীত হয়ে পড়েছিল বাদাবনে।
ছবিটা পাল্টে গেল আমপানের পরে। ঝড়ে তছনছ এলাকার গৃহহীনদের কাছে প্রাথমিক দাবি ছিল দু’মুঠো খাবারের। ফলে ত্রাণ নিয়ে আসছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন। আর সেই ত্রাণের হাত ধরেই ফের সুন্দর-বনের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে প্লাস্টিক। তা নিয়ে আফসোস থাকলেও, এই পরিস্থিতিতে নিরুপায় বাঁধে আশ্রয় নেওয়া সব হারানো মানুষগুলোর। যাঁরা ত্রাণ নিয়ে আসছেন, চটজলদি পরিবেশবান্ধব ব্যাগের ব্যবস্থা করা তাঁদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। সব মিলিয়ে এ এক অদ্ভুত সঙ্কট— বলছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা।
হাসনাবাদের নেবুখালি, বাইলানি রুটে একের পর এক বড় বড় গাড়ি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের রূপমারি পঞ্চায়েতের বাইনাড়া এলাকায় সাতটি বেসরকারি সংগঠন ত্রাণ বিলি করেছে। সকলেই প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগে খাদ্যসামগ্রী দিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মানবেন্দ্র মণ্ডল, বিমল মণ্ডলরা জানান, ত্রাণে প্লাস্টিক ব্যাগই পেয়েছেন তাঁরা। বাইনাড়া, ধানিখালি এলাকার কয়েকশো পরিবার কমপক্ষে ৪০ বার বেসরকারি ত্রাণ পেয়েছেন। এখানকার ৪৫০ পরিবারের কাছে প্রায় ৪০টি করে প্লাস্টিকের ব্যাগ পৌঁছেছে। অর্থাৎ, ছোট একটি এলাকাতেই তিন সপ্তাহে ১৮ হাজার প্লাস্টিক এসেছে। পুরো সুন্দরবন ধরলে হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের!
প্লাস্টিকের দেদার ব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশপ্রেমীরা। বারাসাত রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসব চৌধুরী বলেন, “এই প্লাস্টিকের সিংহভাগ নদীর জলে মিশছে। মিশছে বাঁধ কিংবা আশপাশের মাটিতেও। জীব-বৈচিত্র্যে আগামী দিনে এর প্রভাব পড়বে। নদীপথ দিয়ে কিছু প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রেও মিশবে।” বাসব মনে করেন, এত প্লাস্টিক সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভের বৃদ্ধিতে বাধা তৈরি করবে। দুর্বল হবে নদী বাঁধও। বাইনাড়া গ্রামের বাসিন্দা তপন মণ্ডল, শচীন বাউলিয়া বলেন, “আমাদের পেট তো ওই বেসরকারি ত্রাণেই চলছে। ওঁরা তো আগে আমাদের কথা ভেবেছিলেন। তাই সব হারিয়েও প্রাণে বেঁচে আছি। তবে এখন মনে হচ্ছে পরিবেশের কথাও ভাবতে হবে।” পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের কর্তা অভিজিৎ বর্ধন বলেন, “যাঁরা ত্রাণ নিয়ে আসছেন, তাঁদের উচিত, যতটা সম্ভব পরিবেশবান্ধব প্যাকেট ব্যবহার করা। তা না হলে প্লাস্টিকের ব্যাগগুলিতে ত্রাণ দেওয়ার পরে ফের তা ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।” হিঙ্গলগঞ্জে ত্রাণ দিতে আসা দু’টি সংগঠনের প্রতিনিধি সৈকত মণ্ডল, সমীর মান্না বলেন, “আমরা প্রথমে পরিবেশ নিয়ে ভাবিনি। আসলে হাতের কাছে বিকল্পও কিছু ছিল না। এখন প্লাস্টিকের ব্যবহার কম করার চেষ্টা করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy