—প্রতীকী ছবি।
গাইঘাটার ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে আছে মতুয়াদের আরাধ্য দেবতা হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দির। মতুয়া সমাজের মানুষের কাছে এই ধাম পুণ্যভূমি। ২০০৮ সাল থেকে এই ঠাকুরবাড়িকে ঘিরে এখানকার ভোট-রাজনীতি আবর্তিত হয়ে আসছে। মতুয়াদের সমর্থন কখনও ঢলে পড়েছে তৃণমূলের দিকে, কখনও বা বিজেপির দিকে। মতুয়া-মন পেতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— কে না ছুটে এসেছেন এখানে। বাম আমলে সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতাদেরও আনাগোনা ছিল এখানে। মতুয়াদের প্রয়াত বড়মা বীণাপানি ঠাকুর যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ভোটের মরসুমে রাজনৈতিক দলগুলির প্রার্থীদের এখানে আনাগোনা বেড়ে যেত। বড়মার আশীর্বাদ পেতে মরিয়া ছিল সব পক্ষই।
এখন অবশ্য সে দিন নেই। তবে এখানকার ভোট ঠাকুরবাড়িকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। রাজনৈতিক মহলের মতে, গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে মতুয়াদের বড় অংশের সমর্থন পেয়েছিল বিজেপি। এ বার ভোটে মতুয়া রাজনীতিতে ইন্ধন জুগিয়েছে দু’টি ঘটনা। অভিযোগ, মালদহের একটি সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মতুয়াদের আরাধ্য দেবতা হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাম ভুল উচ্চারণ করেছিলেন। এই ঘটনার পরে মতুয়ারা দাবি তুলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। মতুয়াদের একাংশ পথে নেমে আন্দোলন করেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল গত ১১ জুন। ওই দিন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠাকুরবাড়িতে এসেছিলেন। তাঁর সেই সফর ঘিরে তুলকালাম হয়।তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। দু'পক্ষের অনেকে জখম হয়েছিলেন। অভিষেক হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পুজো না দিয়ে ফিরে যান।
এ বার পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে গাইঘাটা ব্লকে ওই দু’টি ঘটনা উঠে আসছে। মূলত তৃণমূল ও বিজেপি একে অন্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে যুক্তি, পাল্টা যুক্তিতে। পাশাপাশি, মতুয়াদের নাগরিকত্বের বিষয়টিও আসছে আলোচনায়।
গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক তথা অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের মহা সঙ্ঘাধিপতি সুব্রত ঠাকুরের কথায়, "গাইঘাটা ব্লকে মতুয়াদের সম্পূর্ণ সমর্থন আমাদের সঙ্গে থাকবে। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের আরাধ্য দেবতা হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরকে অপমান করার পরেও ক্ষমা চাননি। উল্টে, তাঁর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশ নিয়ে এসে ঠাকুরবাড়িতে দাদাগিরি করলেন। এটা মতুয়ারা মেনে নেবেন না।" বনগাঁর প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ তথা অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতা ঠাকুর পাল্টা বলেন, "অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে ঢুকতে দেননি শান্তনু ঠাকুর। এটা মতুয়ারা মনে নিতে পারছেন না। কারণ, মন্দিরে আসার অধিকার সকলেরই আছে। আর মতুয়ারা এটা জানেন, একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীই মতুয়া ঠাকুরবাড়ি এবং মতুয়াদের জন্য উন্নয়ন করেছেন। এ ছাড়া, সিএএ নিয়ে বিজেপি মতুয়াদের ভাঁওতা দিয়েছে। এ বার মতুয়াদের সমর্থন আমাদের দিকেই থাকবে।"
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, গাইঘাটা ব্লকটি বনগাঁ দক্ষিণ এবং গাইঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা ১৩টি। আসন সংখ্যা ৩১১। পঞ্চায়েত সমিতির আসন ৩৯টি। জেলা পরিষদের আসন ৩টি। তৃণমূল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এখানে ভোটের অঙ্কে সাফল্য পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে তারা পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছিল। বাম আমলে ২০০১, ২০০৬, ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে গাইঘাটা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থীরা। ২০১৬ সালের ভোটেও তৃণমূল জয়লাভ করে।
হাওয়া পাল্টে যেতে শুরু করে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের সময় থেকে। তৃণমূলকে পিছনে ফেলে উঠে আসে বিজেপি। গত পঞ্চায়েত ভোটে অবশ্য তৃণমূল ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছি। তৃণমূল এ বার সব আসনে প্রার্থী দিয়েছে। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, আমপান, আবাস যোজনায় দুর্নীতিতে নেতা-কর্মীদের নাম জড়িয়ে যাওয়া, গোষ্ঠীকোন্দল, নেতাদের অহংকার— এ সব ভোগাতে পারে তৃণমূলকে। যদিও গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সভাপতি গোবিন্দ দাস বলেন, "ব্লকের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত এ বার আমরা দখল করব। ব্লক জুড়ে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। ৯৪ হাজার মানুষ লক্ষ্মীর ভান্ডার পান। রাস্তার কাজ কার্যত কোথাও বাকি নেই। উন্নয়নের নিরিখেই ভোট হবে।"
২০১৯ সাল থেকে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হয়ে ওঠে গাইঘাটা ব্লক। সে বছর লোকসভা ভোট এবং ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে অনেকটাই এগিয়ে ছিল বিজেপি। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে ধর্মপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত বিজেপি দখল করেছিল। গত লোকসভা ভোটে শান্তনু ঠাকুর গাইঘাটা ব্লক এলাকায় এগিয়ে ছিলেন। গত বিধানসভা ভোটে বনগাঁ দক্ষিণ এবং গাইঘাটা দু’টি কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা। তবে এ বার ভোটেবিজেপির গোষ্ঠীকোন্দল এবং জনবিচ্ছিন্নতা ভোগাতে পারে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক মহল মনে করছেন।
গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩১১টি আসনের মধ্যে বিজেপি প্রার্থী দিয়েছে ২৯৭টিতে। পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের সব আসনে বিজেপি প্রার্থী দিয়েছে। ভোটের মরসুমে বিজেপির সব পক্ষকে এক মঞ্চে দেখাও যাচ্ছে। বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি রামপদ দাসের সঙ্গে সকলে সমন্বয় রেখে চলছেন বলে দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে। এত দিন বিজেপি নেতাদের এক সঙ্গে দেখা যায়নি। বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক স্বপন মজুমদার বলেন, "তৃণমূলের চোর, দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে আমরা সকলে মিলে লড়াই করছি। আমাদের মধ্যে কোনও কোন্দল নেই।"
সাম্প্রতিক সময়ে গাইঘাটায় সিপিএমের মিটিং-মিছিলে প্রচুর ভিড় দেখা গিয়েছে। কিন্তু তার প্রতিফলন গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেল না। গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩১১টি আসনের মধ্যে সিপিএম প্রার্থী দিয়েছে ২৩১টিতে। এ ছাড়া, কিছু আসনে ফরওয়ার্ড ব্লক এবং সিপিআই প্রার্থী দিয়েছে। তারপরেও অনেক আসনে বামেদের প্রার্থী নেই।
কেন এই পরিস্থিতি?
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রমেন আঢ্য বলেন, "আমরা যাঁদের প্রার্থী ঠিক করেছিলাম, তৃণমূলের পক্ষ থেকে তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। ফলে শেষ মুহূর্তে অনেকে আতঙ্কে মনোনয়ন জমা করতে সাহস পাননি। তা ছাড়া, নিচুস্তরে কিছু জায়গায় তৃণমূলকে হারাতে আমাদের কর্মীরা নির্দলকে সমর্থন করেছেন। ফলে যেখানে প্রার্থী দিতে পারিনি। শরিক দলগুলির প্রার্থী দেওয়ার কথা ছিল, এমন কিছু আসনে শেষ মুহূর্তে তাঁরা জানান, প্রার্থী দিতে পারছেন না। ফলে দ্রুত সেখানে প্রার্থীঠিক করা যায়নি। তা ছাড়া, কিছুটা আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা থেকে গিয়েছে।" পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের আসনে অবশ্য বামেরা প্রায় সব আসনেই প্রার্থী দিয়েছে।
কংগ্রেস সাংগঠনিক ভাবে এখানে বরাবরই দুর্বল। কিছু আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছে তারা। গ্রামপঞ্চায়েতে ১২টি এবং পঞ্চায়েত সমিতির ৪টি আসনে কংগ্রেসপ্রার্থী দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy