তৃণমূলের মহিলা কর্মী-সমর্থকদের উল্লাস। হেলেঞ্চায় গণনাকেন্দ্রের বাইরে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
লোকসভা ভোটে বাগদায় পিছিয়ে থাকার চল্লিশ দিনের মাথায় এ বার সেখানেই জয়ের স্বাদ পেল তৃণমূল। ২০১৬সালের পরে ফের বাগদায় এই ফলাফলে উচ্ছ্বসিত ঘাসফুল শিবির।
বাগদা বিধানসভার উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী মধুপর্ণা ঠাকুর। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে প্রথম বার ভোটের লড়াইয়ে নেমে তাঁর এই ফল তাক লাগিয়ে দিয়েছে সকলকে। তিনি জয়ী হয়েছেন ৩৩,৪৫৫ ভোটের ব্যবধানে। পেয়েছেন ১,০৭,৭০৬টি ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, বিজেপি প্রার্থী বিনয় বিশ্বাস পেয়েছেন ৭৪,২৫১টি ভোট।
গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়ির মেয়ে মধুপর্ণার জয় খুব সহজ ছিল না বলে অনেকেরই মত। কারণ, সদ্য লোকসভা ভোটে বাগদা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস পিছিয়ে ছিলেন ২০,৬১৪ ভোটে।
সেই ব্যবধান টপকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন মধুপর্ণা।
শনিবার বাগদার হেলেঞ্চা হাই স্কুলে সকাল ৮টা থেকে গণনা শুরুর প্রথম রাউন্ড থেকেই মধুপর্ণা এগিয়ে ছিলেন। বিজেপি প্রার্থী বিনয় কোনও রাউন্ডেই এগিয়ে যেতে পারেননি। ১৩ রাউন্ড গণনা শেষে বেলা ১২টা নাগাদ ফলাফল ঘোষণা হওয়ার আগেই বিজেপি প্রার্থী গণনা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান। ভোটের ফল নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘তৃণমূল পুরোপুরি এখানে ছাপ্পা ভোট করে জয়ী হয়েছে। আমরা সাধ্যমতো আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম। আমার উপরে আক্রমণ হয়েছিল। গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছিল। পুলিশ-প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি।’’
এ দিন গণনা কেন্দ্রের বাইরে ২০০ মিটার এলাকা জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। এলাকায় দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বনগাঁ-বাগদা সড়ক গার্ডরেল দিয়ে আটকে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং রাজ্য পুলিশ গোটা এলাকায় মোতায়েন ছিল।
জয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই তৃণমূল কর্মীরা আনন্দে মেতে ওঠেন। শুরু হয় আবির খেলা, ডিজে বাজিয়ে নাচ। চলে মিষ্টিমুখ। গণণা কেন্দ্রের কাছে তৃণমূলের পক্ষ থেকে শিবির করা হয়েছিল। সকাল থেকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ব্যারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিক, জেলা সভাধিপতি নারায়ণ গোস্বামী এবং তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি
বিশ্বজিৎ দাস।
পার্থ বলেন, ‘‘এই জয় মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নের প্রতি মানুষের আস্থার জয়। আমরা মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলাম। তাঁদের ক্ষোভের কথা শুনেছিলাম। দুর্নীতি করলে কাউকে ছাড়া হবে না, তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলাম। দুর্নীতির বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি, জিরো টলারেন্স।’’ নারায়ণ বলেন, ‘‘এটা যে এ রাজ্যের ভোট, মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নের ভোট— তা আমরা মানুষকে বোঝাতে পেরেছি বলেই এই সাফল্য।’’
তৃণমূল কর্মীরা ছোট ছোট মিছিল করেন এলাকায়। বহু মতুয়া ভক্ত ডাঙ্কা-নিশান নিয়ে তাতে সামিল হন। ২০১৬ সাল থেকে বিধানসভা ও লোকসভা ভোটে তৃণমূল এখানে পরাজিত হয়ে আসছে। এ দিনের ফলে উচ্ছ্বসিত এক তৃণমূল কর্মী বলেন, ‘‘এত দিন পরে আমাদের শাপমোচন হল।’’
জয়ের পরে মধুপর্ণার প্রতিক্রিয়া, ‘‘দিদির (মুখ্যমন্ত্রী) জন্যই এই জয় সম্ভব হয়েছে। বাগদার মানুষ বুঝেছেন, ওঁকে ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।’’ মধুপর্ণার মা, তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতা ঠাকুরের কথায়, ‘‘আমরা ভাবতে পারিনি, এত ভাল ফল
করবে মধুপর্ণা।’’
বাম প্রার্থী, ফরওয়ার্ড ব্লকের গৌর বিশ্বাস পেয়েছেন ৮,১৮৯ ভোট। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সত্যসেবী কর বলেন, ‘‘লোকসভার তুলনায় বাগদায় আমাদের ভোট বেড়েছে।’’ কংগ্রেস প্রার্থী অশোককুমার হালদার পেয়েছেন মাত্র ১,২৯৭ ভোট। বিজেপির বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থী সত্যজিৎ মজুমদারও কোনও দাগ কাটতে পারেননি। তিনি পেয়েছেন ১,৪৩৮টি ভোট।
ভোটের ফল প্রকাশের পরে মতুয়াদের ‘বড়মা’ বীণাপাণি ঠাকুরের ঘরের তালা ভাঙলেন মতুয়া ভক্তেরা। তারপরে সেই ঘরে ঢুকে বড়মার মূর্তিতে প্রণাম করেন মধুপর্ণা। তাঁর মা মমতা ঠাকুর বলেন, ‘‘মতুয়া ভক্তেরা তালা ভেঙেছেন। ঘর পরিস্কার করতে কয়েক দিন সময় লাগবে। তারপরে আমরা আবার ওই ঘরে থাকব।’’ এ বছর মতুয়া ধর্ম মহামেলা চলাকালীন অভিযোগ ওঠে, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর লোকজন নিয়ে বড়মার ঘরের তালা ভেঙে তার দখল নিয়েছেন। সেখানে নতুন তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। মমতা ঠাকুর মেয়েকে নিয়ে ওই ঘরে থাকতেন। এরপর থেকে মমতা মেয়েকে নিয়ে পাশের একটি ঘরে থাকতে শুরু করেন। প্রতিবাদে মধুপর্ণা লোকসভা ভোটের সময়ে অনশনও করেছিলেন। মমতা এ দিন বলেন, ‘‘আমরা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এ দিন ভোটের ফল প্রকাশের পরে তালা খোলা হয়।’’ এ বিষয়ে অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলেন, ‘‘যে বা যাঁরা ঘরের তালা ভেঙেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা হবে। ঘর ফের আগের জায়গায় ফিরে যাবে, যতক্ষণ না হাই কোর্ট রায় দিচ্ছে।’’ মমতার দাবির বিষয়ে শান্তনু বলেন, ‘‘কে হাই কোর্টে রায় পেয়েছে, আর কে পায়নি— তা সময় এলে দেখা যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy