মন্দিরের ভিতরে প্রতিমা। —নিজস্ব চিত্র
‘কী রে আমাকে বেলের সরবত খাওয়াবিনে?’
প্রায় দু’শো বছর আগের কথা। প্রশ্নকর্তা শ্রীরামকৃষ্ণ। রানি রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাসের পৈতৃক ভিটে স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী বিথারি গ্রামে এসে এ কথা বলেছিলেন তিনি। ওই গ্রামে প্রাচীন এক কালীমন্দির আছে। জনশ্রুতি, যখন এসেছিলেন তখন ওই মন্দিরেও গিয়েছিলেন রামকৃষ্ণদেব। তাঁর পদধূলিধন্য চারশো বছরের পুরনো ওই মন্দিরে পুজো দেখতে আজও ভিড় জমান সাধারণ মানুষ।
বহু বছর আগের কথা। কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে গোপাল সার্বভৌম চক্রবর্তীর বেদপাঠ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য। তাঁর অভিষেকের দিন গোপালকে যশোহরে গিয়ে বেদপাঠের আমন্ত্রণ জানান তিনি। এক সময়ে এই বিথারি-সংলগ্ন এলাকা দিয়ে বইত নদী। কালস্রোতে সেই নদী বাওড়ে পরিণত হয়েছে। নির্দিষ্ট দিনে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে গোপাল সেই নদীপথে যশোরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে অমাবস্যার সন্ধ্যায় জঙ্গলে পথ হারিয়ে বিথারি গ্রামে হাজির হন তাঁরা। সেখানে সে রাতে কালীমূর্তি গড়ে পুজো করেন গোপাল। পুজো শেষে মূর্তি বিসর্জনের জন্য তোলার চেষ্টা করে বিফল হয়ে শেষে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। কথিত আছে, ওই রাতে দেবীর স্বপ্নাদেশ পান গোপাল। স্বপ্নে দেবী গোপালকে জানান, গোপাল যেন এখানেই বসবাস করে তাঁর প্রতিষ্ঠা করে সেবা করেন তাঁর। প্রতাপাদিত্য সব ব্যবস্থা করে দেবেন— এমনও স্বপ্নাদেশে বলেন দেবী। স্বপ্নাদেশের কথা মাথায় রেখেই গোপাল এ বার যশোরের রাজবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। সেখানে পৌঁছে পথের সমস্ত অভিজ্ঞতা রাজাকে জানান তিনি। সব শুনে প্রতাপাদিত্য শতাধিক একর জমি দান করেন গোপালকে। জঙ্গল কেটে মন্দির প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সেই জমিতে বসতিও স্থাপন হয়।
পরবর্তীতে সেবায়েত এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রচেষ্টায় সেই জমির উপরে পুকুর, বটগাছ, আমবাগান-সহ মন্দির এবং নাটমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।
এই মন্দির থেকে কয়েকশো গজ দূরে মথুরমোহনের বাড়ি। ওই পরিবারের কল্যাণকুমার বিশ্বাস, দিবাকর বিশ্বাস বলেন, ‘‘মথুরমোহনকে নিয়ে বাংলাদেশের তালা থানার মাগুরা গ্রামে গুরুবাড়ি যাওয়া-আসার পথে শ্রীরামকৃষ্ণ দু’বার আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। মথুরমোহন যেখানে জন্মেছিলেন সেখানে হরিতকী গাছের পাশে বেলগাছের নিচে একটি বেদি ছিল। সেই বেদিতে বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন রামকৃষ্ণদেব।’’
পরবর্তীতে কালী মন্দিরের উন্নতিকল্পে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ওই বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক শ্রীকুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘‘রানি রাসমণি মন্দির সংস্কারের জন্য অর্থসাহায্য করেছিলেন। বিথারি ও আরশিকারি গ্রাম দু’টি মথুরমোহনের জমিদারির মধ্যে পড়ায় মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে তিনি সাহায্য করতেন। মন্দিরে প্রতিমা দর্শনে এসেছিলেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ।’’
মন্দিরের সেবায়েতরা পালা করে পুজো করেন। এ বারে শীতল চক্রবর্তীর পরিবারের পালা পড়েছে। বয়স্ক সেবায়েত অনিলকুমার চক্রবর্তী, পার্থ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘স্থানীয় গোয়ালবাথান গ্রামে কলেরা মহামারির আকার নিয়েছিল। বিশ্বাস, মানুষ সে বার কালীমন্দিরে এসে দেবীর কাছে হত্যে দেওয়ায় কারও মৃত্যু হয়নি। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের শেষ মঙ্গলবারে তাই গ্রামের সকলে কালীমন্দিরে এসে পুজো দেন। সে দিন মন্দিরপ্রাঙ্গণে মেলা বসে।’’ এ ছাড়া প্রতি বছর মাঘ মাসে চতুর্দশীর রাতে সাড়ম্বরে রটন্তীকালী পুজোও হয়। মাকে সেদিন খয়রা মাছ রান্না করে দেওয়ার রীতি আছে। অনেকেই তাই এই কালীকে খয়রাখাকি কালীও বলেন। পুজোর দিনে দেবীকে ৮-১০ ভরির স্বর্ণ অলঙ্কার দিয়ে সাজানো হয় বলে পুলিশ প্রহরা থাকে। পুরোহিত মনোজিৎ মৈত্র এবং কমল চক্রবর্তী জানান, এ দিন ৫-৭টি ছাগল বলি হয়। পুজোর দিনে সাত গাঁয়ের মানুষ মন্দির প্রাঙ্গণে প্রসাদ পান। গ্রামবাসীরা জানান, শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলি এ গ্রামে পড়ায় ধন্য তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy