ধুয়ে গিয়েছে বাঁধা। ঠাইনাড়া বহু পরিবার। গোসাবায়। —ফাইল ছবি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধ ভাঙলে বহু মানুষের ক্ষতির দৃশ্য চোখে দেখাই যায়। অলক্ষে কত মানুষের আবার মুখে হাসি ফোটে, তা নিয়েও চর্চা আছে রাজ্য রাজনীতিতে। গ্রামের প্রবীণেরা অনেকেই জানেন, এমন পরিস্থিতিতে বাঁধ-ভাঙা হাসিও ফোটে অনেকের মুখে! রেমালের জেরে বড়সড় বিপর্যয় না ঘটায় নেতারা কেউ কেউ হতাশ— মনে করেন নানা সময়ে দুর্যোগের শিকার দুই ২৪ পরগনার উপকূতবর্তী এলাকার বহু মানুষ।
বাঁধ ভাঙলে মেরামতির জন্য বরাদ্দ অর্থ থেকে চুরি, ঠিকাদারের থেকে কাটমানি, ত্রাণের টাকা-মালপত্র চুরির অভিযোগ এ রাজ্যে বাম-ডান দুই আমলেই সমানতালে উঠেছে। সুন্দরবনের পাখিরালয়ের বাসিন্দা সুনীতা দোলুই বলেন, ‘‘বাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢুকে আমাদের ক্ষতি তো নতুন নয়। কিন্তু অনেকের তাতে লাভও প্রচুর।’’ কিন্তু লাভের মুখ দেখেন কারা? আর মুখে কথা সরে না সুনীতার। শুধু গজগজ করতে করতে বললেন, ‘‘এলাকার সব দলের নেতাদের চেনা আছে!’’
গোসাবার কালীদাসপুরের বাসিন্দা নিতাই অধিকারী অবশ্য তুলনায় সোজাসাপ্টা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতি দুর্যোগেই বাঁধ ভাঙে এই এলাকায়। ফের বাঁধে মাটি দেওয়া হয়। এ বারও ভাঙত। কিন্তু গ্রামের মানুষ সেচ দফতরের সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে ভাঙন রুখে দিয়েছে। তবে এটাও ঠিক, নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের কিছু মানুষ চায়, প্রতি বছর বাঁধ ভাঙুক।’’ কংক্রিটের বাঁধের দাবি সুন্দরবনের সিংহভাগ জায়গায় এখনও অধরাই। কালীদাসের মতে, ‘‘কংক্রিটের বাঁধ তৈরি করলে অনেকের অসুবিধা। তা হলে তো বছর বছর বাঁধ ভাঙার জন্য ত্রাণের টাকা ঢুকবে না, কাটমানি-লুটেরও সুযোগ থাকবে না!”
গ্রামবাসীদের কথা যে একেবারে অমূলক নয়, তা মেনে নিচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। বিজেপির জয়নগর সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক বিকাশ সর্দার বলেন, ‘‘বাঁধ ভাঙলেই তো লাভ নেতাদের। বছর বছর ভাঙা বাঁধ মেরামতির জন্য সরকারি টাকা চুরি করবে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাটমানি খাবে। এতগুলো বছর তৃণমূল সরকারে রয়েছে, কিন্তু কংক্রিটের বাঁধ তৈরির কোনও উদ্যোগই করেনি।’’ আরএসপি নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুভাষ নস্করের কথায়, ‘‘কংক্রিটের বাঁধ তৈরির ইচ্ছেই নেই তৃণমূলের। আমরা ৫০৩২ কোটি টাকা এনে দিয়েছিলাম কেন্দ্র থেকে। সেই টাকার ৪০০০ কোটি টাকার বেশি ফেরত চলে গেল, রাজ্য সরকার বাঁধ তৈরি করল না বলে। মুখ্যমন্ত্রী জমি অধিগ্রহণের জন্য পরিবার পিছু একটা করে চাকরি দেবেন বলেছিলেন। সেই জমিও আর অধিগ্রহণ হয়নি অধিকাংশ জায়গায়।”
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের উপাধ্যক্ষ তথা গোসাবা ব্লক তৃণমূল নেতা অনিমেষ মণ্ডল বলেন, ‘‘বিরোধীরা কখনওই গঠনমূলক আলোচনা করতে পারে না। লাগাতার বাঁধের পরিচর্যার কারণেই বাঁধ ভাঙেনি দুর্যোগে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু জায়গায় কংক্রিটের বাঁধ তৈরি হয়েছে। আরও বেশ কিছু ভাঙনপ্রবণ এলাকায় কংক্রিটের বাঁধের প্রস্তাব দেওয়া রয়েছে। সেখানেও কংক্রিটের বাঁধ তৈরি হবে। ৩৪ বছর ধরে বামেরা তো ক্ষমতায় ছিল, তারা কেন কংক্রিটের বাঁধ করতে পারেনি?’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘বিজেপি তো কেন্দ্রে রয়েছে, তারা কেন বাঁধ তৈরির জন্য উপযুক্ত অর্থ বরাদ্দ করছে না সুন্দরবনের জন্য?”
বাঁধ ভাঙার সমস্যা আছে উত্তর ২৪ পরগনার বহু এলাকাতেও। সন্দেশখালিতে বেআইনি ভেরির কারবারের ফলে বাঁধ দুর্বল হয় বলেও অভিযো দীর্ঘ দিনের। স্থানীয় বিজেপি নেতা বিকাশ সিংহের কথায়, ‘‘তৃণমূল জমানায় নতুন করে কংক্রিটের বাঁধ তেমন কিছুই হয়নি। বাঁধ সারাইয়ের নামেও ওরা টাকা লুট করেছে। আর ওদের নেতাদের মদতেই বাঁধের পাশে বেআইনি ভেড়ি তৈরি করে বাঁধ আরও দুর্বল করেছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বাঁধ ভাঙলেও অবশ্য তৃণমূল নেতাদের লাভ। তখন ত্রাণের ত্রিপল-চাল চুরি করতে পারবে!’’ শাসক দলের কড়া সমালোচনা করেছেন বসিরহাটের সিপিএম প্রার্থী নিরাপদ সর্দারও। তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের কোনও নজর নেই সুন্দরবন এলাকার নদীবাঁধ কংক্রিটের করার দিকে। ফলে বাঁধ ভাঙার আতঙ্ক নিয়েই সারা বছর কাটান মানুষ।’’
তৃণমূলের সন্দেশখালির বিধায়ক সুকুমার মাহাতো আবার বলেন, ‘‘নদীবাঁধ কংক্রিটের করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাগে। রাজ্য সরকার নিজেদের সামর্থ্যে একটু একটু করে বিভিন্ন জায়গায় কংক্রিটের বাঁধ করছে। বিরোধীরা শুধু সমালোচনাই করতে জানে।’’ শাসক দলের মদতে বেআইনি ভেড়ির কারবার চলে বলে মানতে চাননি তিনি। সুকুমারের কথায়, ‘‘বেআইনি ভেড়ি বামফ্রন্ট আমল থেকে ছিল। পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। তবে পুলিশ-প্রশাসন মাঝে মধ্যে ব্যবস্থা নেয়।’’ নিরাপদের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘আমাদের আমলে বেআইনি ভেড়ি ছিল না, সে কথা বলব না। কিন্তু এখনকার মতো এ সবের রমরমা ছিল না। বাঁধকে দুর্বল করে, মানুষের প্রাণের বিনিময়ে বেআইনি কারবারে আমরা কখনও কাউকে মদত দিইনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy