ফাইল চিত্র।
পরিস্রুত এবং আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের সমস্যা আজও মিটল না উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। সর্বত্র পাইপ লাইনের মাধ্যমে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু গ্রামীণ এলাকা নয়, অনেক পুর এলাকাতেও পাইপ লাইনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছয়নি।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, গঙ্গার জল পাইপ লাইনের মাধ্যমে এনে তা পরিস্রুত করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে। তবে এখনও সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। গঙ্গার জল আনার কাজ শেষ হলে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা থাকবে না। প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ কেনা জলের উপরে নির্ভর করেন। বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন, কেনা জল আর্সেনিকমুক্ত ও পরিস্রুত। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জেলা জুড়ে ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে বেআইনি পানীয় জলের কারবার। ব্যাঙের ছাতার মতো গ্রাম-শহরে গজিয়ে উঠেছে বেআইনি পানীয় জলের কারখানা।
বেআইনি এই কারবার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়ার্নমেন্টাল স্টাডিজের শিক্ষক গবেষক তথা জল বিশেষজ্ঞ তড়িৎ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভূগর্ভস্থ জলের উত্তোলন করে চারিদিকে ব্যবসা চলছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। এর ফলে ভূগর্ভস্থ জলের ভান্ডার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।’’ তাঁর মতে, ভূগর্ভস্থ জল তোলার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। না হলে আগামী দিনে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। এমনিতেই গরমের মরসুমে চাষের জন্য প্রচুর ভূগর্ভস্থ জল লাগে। তার উপরে বেআইনি কারবারের জন্য আরও জল তুললে মাটির নীচের জলস্তর কমতে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটির নীচের জলস্তর বেশি নেমে গেলে শিলার মধ্যে থাকা আর্সেনিক, ফ্লোরাইডের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। এর ফলে তা জলে মেশে। পরে জলস্তর বাড়লে তাতে মিশে বাড়ায় দূষণ।
আর্সেনিক-মিশ্রিত পানীয় জল স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। পাশাপাশি, ভূগর্ভস্থ জল দিয়ে জলসেচের মাধ্যমে তা খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যেও ঢুকছে, যা শরীরে পৌঁছে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা।
বেআইনি পানীয় জলের কারখানায় মাঝে মধ্যেই অভিযান চালায় পুলিশ। কারখানা সিল করা হয়। ধরপাকড়ও হয়। জল পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করা হয়। অভিযোগ, এত কিছুর পরেও জেলায় বেআইনি পানীয় জলের কারবার রমরমিয়ে চলছে।
আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি সূত্রে জানানো হয়েছে, জেলার ২২টি ব্লকেই পানীয় জলে উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। অভিযোগ, সরকারি পাইপ লাইনের জল বা গভীর নলকূপের জল নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। ফলে সেই জলে আর্সেনিকের মাত্রা কত, তা মানুষ জানতে পারেন না। তাই মানুষ আর্সেনিক দূষণ থেকে বাঁচতে কেনা জলের উপরে নির্ভর করেন।
তাঁদের অনেকেরই ধারণা, কেনা জলে আর্সেনিকের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। এ সবের ফলে কেনা জলের চাহিদা থাকায় বেআইনি পানীয় জলের কারবার জেলায় ফুলেফেঁপে উঠেছে।
উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায় আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে প্রচুর গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। অভিযোগ, সেই নলকূপের জল নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। অনেকে আবার বাড়িতে থাকা সাধারণ পানীয় জলের কলের জল পান করেন। যা খুবই বিপজ্জনক প্রবণতা।
আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাস বলেন, ‘‘আমাদের দেশে জল নিয়ে সামগ্রিক বিজ্ঞানভিত্তিক কোনও পরিকল্পনা নেই। ফলে যে কোনও ব্যক্তি ভূগর্ভস্থ জল তুলে নিজের ব্যবসার কাজে বা চাষের জন্য ব্যবহার করতে পারে। কোনও ব্যক্তি অপ্রয়োজনে জল তুলে অপচয়ও করতে পারে। ভূগর্ভস্থ জল অবৈজ্ঞানিক ভাবে তোলার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে আর্সেনিক দূষণ-সহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এই বিপুল মিষ্টি জলকে ব্যবহার করার জন্য কোনও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা না থাকায় তা পরে ব্যবহার করা যায় না। বরং বন্যার সৃষ্টি করে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য যে ব্যবসায়ীরা ভূগর্ভস্থ জল তুলে বিক্রি করছেন, তা এখনই বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’’
অশোক বলেন, ‘‘উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় এমনিতেই ভূগর্ভস্থ জলের অভাব। বেআইনি জল কারখানার ফলে ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্কট তৈরি করছে। ভূগর্ভস্থ জল তোলার ফলে জায়গাটা ফাঁকা হচ্ছে। আর্সেনিক পাইরাইটিস ভেঙে নতুন যৌগ তৈরি হচ্ছে। ওই যৌগ জলে মিশে আর্সেনিকের বিষ সৃষ্টি করছে।’’
পুলিশ জানিয়েছে, বেআইনি জলের কারবার বন্ধ করতে কয়েক বছরের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার, দত্তপুকুর, আমডাঙা, হাবড়া, অশোকনগর, গাইঘাটা, গোপালনগর, বাগদা, বারাসত এলাকায় অভিযান চলেছে। বেশ কয়েকটি বেআইনি পানীয় জল উৎপাদন কারবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেআইনি ওই কারবারে জড়িত কয়েক জনকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে।
পানীয় জল উৎপাদন করতে হলে কেন্দ্রের এসডব্লুআইডি ও বিআইএস দফতরের অনুমতি থাকতে হয়। এক জন কেমিস্ট ও এক জন মাইক্রো বায়োলজিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। বেশিরভাগ কারখানাগুলিতে এ সব থাকে না।
অশোক বলেন, ‘‘টাকা দিয়ে কেনা জলেও উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক থাকে। এ সম্পর্কে মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy