অনেকটা দেরি হয়ে গেলেও পুলিশ কর্মীর উদ্যোগে প্রাণে বেঁচেছেন হিঙ্গলগঞ্জের সাধনা গায়েন। কিন্তু এই রাজ্যের গাঁয়ে-গঞ্জে বহু মানুষেরই ভাগ্য ততটা প্রসন্ন হয় না। সাপে কাটার পরে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা ওঝা-গুণিনের কাছে ফেলে রেখে বা ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসার চেষ্টা চালিয়ে রোগীর প্রাণসংশয়ের পরিবেশ ঘনিয়ে আসে। মারাও যান অনেকে। বহু ক্ষেত্রেই ওঝার হাতে দীর্ঘক্ষণ ফেলে রেখে রোগীকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার সাপে ছোবল মারলে কী করতে হবে, তা-ই বুঝে উঠতে পারেন না বাড়ির লোকজন। ফলে বিপদ ঘনায়।
ক্যানিং মহকুমার জীবনতলার দক্ষিণ হোমরা গ্রামের কমলা হালদারের কথাই ধরা যাক। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা নাগাদ ঘুম থেকে ধড়ফড় করে ওঠেন তিনি। শুরু হয় পেটের যন্ত্রণা, গা বমি বমি। সঙ্গে শরীরে তীব্র জ্বালা।
বছর পঞ্চান্নর কমলাদেবী ছুটে যান পাশেই ভাইয়ের বাড়িতে। পরিস্থিতি দেখে সকলে অনুমান করেন, কালাচ সাপে কেটেছে কমলাদেবীকে।
কিন্তু এই অবস্থায় কী করণীয়, তা ঠাহর করে উঠতে পারেননি কেউ। খানিক নিম পাতা বেটে খাওয়ান হয় কমলাদেবীকে। তাতেও কোনও কাজ হয়নি। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসে প্রৌঢ়ার শরীর। এ বার তাঁকে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় এক হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। তিনি জানিয়ে দেন, কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তখন স্থানীয় মানুষ কমলাদেবীকে নিয়ে যান ওঝা কাবিল জমাদারের কাছে। ততক্ষণে অবশ্য সব শেষ। শুক্রবার সকালে বাড়ির অদূরেই মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয় কমলাদেবীর শরীর।
কুসংস্কার ও অজ্ঞতার কারণে এমন অনেক সাপে কাটা রোগী মারা যাচ্ছেন। সরকারি ভাবেও তাঁদের নাম নথিভুক্ত হয় না বলে জানাচ্ছে সাপে কাটা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজে যুক্ত সংগঠনগুলি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ময়না-তদন্ত হয় না। সরকারি ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ মেলারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না।
কমলাদেবীর ভাইপো রঞ্জিত হালদার বলেন, ‘‘পিসিকে যে সাপে ছোবল মেরেছে, প্রথমে আমরা তা বুঝতেই পারেনি। পরে যখন বুঝলাম, তখন আর কিছু করার ছিল না। ভোরের দিকে তিনি মারা যান।’’
দক্ষিণ হোমরা গ্রামের ওই ওঝা কাবিল জমাদার বলেন, ‘‘এটা ঠিকই, যে আমি এক সময়ে ওঝা, গুণিনের কাজ করতাম। পরে জানতে পারি, ক্যানিঙে সাপ নিয়ে কাজ করে যুক্তিবাদী সংস্থা। ওই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বুঝতে পারি, বিষধর সাপে ছোবল মারলে ওঝা বা গুণিনের কিছুই করার থাকে না। একমাত্র হাসপাতালেই চিকিৎসা সম্ভব।’’
কাবিল বলেন, ‘‘ওঁকে সম্ভবত বিষাক্ত সাপে ছোবল মেরেছিল। আমার কাছে আরও আগে এলে হাসপাতালেই নিয়ে যেতে বলতাম।’’ তাঁর দাবি, ‘‘আমি যুক্তিবাদী সংগঠনেরর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরে থেকে অনেকে সাপে কাটা রোগীকে আমার কাছে আনা হয়েছে। আমি সকলকেই নিজের উদ্যোগে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়েছি।’’
ক্যানিঙের যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার সম্পাদক বিজন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এখনও অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা সাপে কামড়ানো রোগীকে প্রথমে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ওঝা, গুণিনের কাছে নিয়ে যান বা ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে চান। কমলাদেবীকে যদি প্রথমেই হাসপাতালে নিয়ে আসা যেত, তা হলে হয় তো তাঁকে বাঁচানো যেত।’’ তাঁর মতে, মানুষের কুসংস্কার ও অজ্ঞতার কারণেই অনেকে সাপের ছোবলে মারা যাচ্ছেন। এ জন্য তাঁরা ওঝা-গুণিনদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বলেও জানালেন। যাতে সাপে ছোবল মারলে করণীয় কী তা সাধারণ মানুষকে জানাতে পারেন তাঁরা। দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেন। তাঁর আরও দাবি, সাপের কামড়ের সঠিক চিকিৎসা যে সরকারি হাসপাতালে হয়, তা বহু মানুষ জানেনই না। সরকারের এ নিয়ে আরও প্রচার চালানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসীম দাস মালাকার মেনে নিচ্ছেন, সাপের ছোবলে মৃত্যুর বহু ঘটনা সব সময় নজরে আসে না। সাপে কাটা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে যথেষ্ট প্রচার চালান বলেই দাবি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy