বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতাল। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
তৃণমূলের ‘ঘরের দুলাল’ কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে আগেই বিধানসভা ভোটে টেক্কা দিয়েছিলেন তাঁর পুরনো সহকর্মীদের। বাগদা কেন্দ্রের বিধায়ক এখন আবার পদ্মশিবিরে। আগে থেকেই অবশ্য শতধাবিভক্ত বাগদা-তৃণমূল। কিছু দিন আগে দলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে এলাকায় সভা করতে এসে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘এ বার নিজেদের মধ্যে কচকচানি বন্ধ করুন।’’ বিভাজন সামলে তৃণমূল বাগদায় আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা, তা নিয়ে তা নিয়ে ভোটের আগে জল্পনা চলছে এলাকায়। বিজেপি বা বামেরা এই সুযোগকে কতটা কাজে লাগাতে পারে, তা নিয়েও আছে কৌতুহল। সেই সঙ্গে দুলাল বরের ভাগ্যে এ বার টিকিট মেলে কিনা, তা জানতেও কৌতুহলী রাজনৈতিক শিবির।
ইতিমধ্যে আমপান দুর্নীতি নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়েছে এলাকায়। তৃণমূল-বিজেপির বিরুদ্ধেই উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। এলাকায় অনুন্নয়ন নিয়েও অভিযোগ ভুরি ভুরি।
২০১৬ সালে বিধানসভা ও গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের এখানে ভরাডুবি হয়েছে। ক্ষত সামাল দিতে ইদানীং তৎপরতা চোখে পড়ছে তৃণমূল শিবিরে। সময় প্রচুর দিচ্ছেন দলের জেলা কো-অর্ডিনেটর গোপাল শেঠ। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, নিজেদের মধ্যে দূরত্ব নাকি অনেকটাই কমেছে। যদিও দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, স্থানীয় নেতানেত্রীদের অনেকেই বিধানসভা ভোটে দলের টিকিটের দাবিদার। ফলে দলের অন্দরে চোরাস্রোত একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না।
মতুয়া ভোট এখানে গুরুত্বপূর্ণ বরাবরই। মতুয়াদের নাগরিকত্ব নিয়ে তৃণমূল-বিজেপির চাপানউতরে শেষমেশ মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক কোন দিকে ঝোঁকে, তার উপরেও নির্ভর করবে ভোটের ফল।
এক সময়ে বাগদা ছিল তৃণমূলের খাসতালুক। বাম আমলে, ২০০৬ সালে গোটা রাজ্যে তৃণমূলের ভরাডুবির মধ্যেও বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন তৎকালীন তৃণমূল প্রার্থী দুলাল বর। বাম আমলেই ২০০৩ সালে বাগদা পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছিল তৃণমূল। সেই বাগদাতেই ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের প্রচারে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপরেও বাগদা কেন্দ্রে তৃণমূলের ভরাডুবি হয়। পিছিয়ে থাকার কারণ হিসাবে দলীয় কোন্দলের পাশাপাশি মূলত উঠে আসে পঞ্চায়েত ভোটে লাগামহীন সন্ত্রাসের অভিযোগ। বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, ব্যালট বাক্স পুড়িয়ে দেওয়া— কিছুই বাদ যায়নি। পরিস্থিতি শাসকদলের বিরুদ্ধে গিয়েছিল বলেই রাজনৈতিক মহলের মত।
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বর কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে দাঁড়ান। বামেরা কংগ্রেস প্রার্থী দুলালকে সমর্থন করে। ফের ভোটে জিতে যান দুলাল। তৃণমূলের একাংশের ভোট তিনি পেয়েছিলেন বলে ঘাসফুল শিবিরের অন্তর্তদন্তে উঠে আসে।
পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে বিজেপি এখানে শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে। বিজেপি দু’টি পঞ্চায়েত দখলও করে। পঞ্চায়েত সমিতির ৬টি আসনও তারা ছিনিয়ে নিয়েছিল। লোকসভা ভোটের আগে দুলাল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন। করোনা পরিস্থিতিতে রেশন দুর্নীতি এবং আমপান পরবর্তী সময়ে ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিজেপি লাগাতার আন্দোলন করেছে। বিজেপি নেতা অমৃতলাল বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সরকারি টাকা বিলি নিয়ে শাসকদল এখানে চূড়ান্ত স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি করেছে।’’
সিপিএম নেতা সুশান্ত চক্রবর্তী আবার বলেন, ‘‘জবকার্ডে কাজ করা মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছে তৃণমূল। আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরিতে দুর্নীতি হয়েছে।’’
তৃণমূলের বাগদা বিধানসভার চেয়ারম্যান তরুণ ঘোষ আবার বলেন, ‘‘আমপানে আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ নেই। ক্ষতিগ্রস্তেরা সকলেই টাকা পেয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও যাঁরা টাকা পেয়েছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন।’’
যদিও দুলালের অভিযোগ, ‘‘আমি প্রশাসনের কাছে বার বার ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চেয়ে আবেদন করেও তালিকা পাইনি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তেরা টাকা পাননি।’’এই আকচাআকচির মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফেরেনি বলে অভিযোগ। বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালটুকুই ভরসা। পরিকাঠামো খুবই দুর্বল বলে জানালেন মানুষজন। হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ অপারেশন থিয়েটারই নেই। তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। অতীতে সেখানে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা থাকলেও অনেক কাল আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
ঝুপা এলাকায় ইছামতী নদীর উপরে, হাদিখালি-ভুলোট-বাগি সহ কয়েকটি এলাকায় কোদালিয়া নদীর উপরে এবং রাঘবপুরে বাওরের উপরে সেতু তৈরির দাবি এখনও মেটেনি। রেলপথ নেই। মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন বনগাঁ থেকে বাগদা পর্যন্ত রেলপথ তৈরির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে জমি চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়। তারপরে সব ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। বছরের বেশিরভাগ সময় বনগাঁ-বাগদা সড়ক বেহাল থাকে বলে অভিযোগ।
কৃষিভিত্তিক এলাকায় হিমঘরের দাবি দীর্ঘ দিনের। আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের সমস্যা আছে। ইছামতী, কোদালিয়া, বেতনা, কপোতাক্ষ নদী সংস্কারের অভাবে মজে গিয়েছে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন যাঁরা, তাঁদের অন্য কাজ খুঁজে নিততে হয়েছে।
সিপিএমের বাগদা এরিয়া কমিটির সম্পাদক সুশান্ত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিধায়ক বলেছিলেন বাপের বেটা হলে দলত্যাগ করবেন না। কিন্তু কথা রাখেননি। সর্বত্র পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তা করতে পারেননি। তবে কোথাও কোথাও স্বজলধারা প্রকল্প হয়েছে।’’
তৃণমূল নেতা গোপাল শেঠের কথায়, ‘‘বার বার দল বদলে উনি নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা বলতে আর কিছু বাকি রাখেননি। এলাকার উন্নতি বা মানবিক প্রয়োজনে বিধায়কের কোনও ভূমিকা ছিল না গত কয়েক বছরে।’’
কী বলছেন দুলাল?
তাঁর কথায়, ‘‘৫০টি সজলধারা প্রকল্পের মাধ্যমে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছি। তার মাধ্যমে ১০০ জন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। করোনার সময় ৫ লক্ষ টাকার ত্রাণ বিলি করেছি ব্যক্তিগত ভাবে। সব সময়ে মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকি।’’ হাসপাতাল ও সেতুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘বিধায়ক তহবিলের টাকায় সেতু বা হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নতি সম্ভব নয়। সে জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। তারা পদক্ষেপ করেনি।’’ আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকেও সাধ্য মতো সাহায্য করেছেন বলেও দাবি তাঁর।
দল বদল প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল যা অসম্মান করেছে আমাকে, তাতে বিজেপিতে না গেলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারতাম না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy