Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus Lockdown

বাড়ি ছেড়ে না বের হলে প্রাণে বাঁচতাম না

গোসাবার কুমিরমারি গ্রামের বাসিন্দা হলেও বছর দু’য়েক আগে বিয়ে করে রাঙাবেলিয়ায় সংসার পাতেন এই যুবক।

সুকুমার ও তাঁর পরিবার। নিজস্ব চিত্র

সুকুমার ও তাঁর পরিবার। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
রাঙাবেলিয়া শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২০ ০৪:৪২
Share: Save:

আয়লায় সবই হারিয়েছিলেন। সে বার বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। নদীর বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সব কিছু। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় সুকুমার গায়েনকে। বিএ প্রথম বর্ষে কলেজে ভর্তি হয়েও আর পড়াশোনা হয়নি। বুঝতে পারেন বেঁচে থাকার জন্য বই নয়, চাই ভাত। আর তাই নতুন করে বাঁচতে, ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেন কাজের তাগিদে। কেরলে গত দশ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করছেন তিনি। বছরে দু’এক মাসের জন্য বাড়ি ফেরেন।

গোসাবার কুমিরমারি গ্রামের বাসিন্দা হলেও বছর দু’য়েক আগে বিয়ে করে রাঙাবেলিয়ায় সংসার পাতেন এই যুবক। স্ত্রী শ্যামলী ও বছরখানেকের ছেলে সমীরণকে নিয়ে ছোট সংসার সুকুমারের। পরিবারের বাকিরা সকলেই কুমিরমারি থাকেন। রাঙাবেলিয়ায় সামান্য জায়গা কিনে চাঁচের বেড়া আর অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দিয়ে ঘর বানিয়েছেন এই যুবক। আয়লায় বাড়ি ঘর হারানোর পর ঘরই যেন হয়ে উঠেছিল সুকুমার আর শ্যামলীর শান্তির আশ্রয়। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু মাস দু’য়েক আগে লকডাউন শুরু হওয়ায় কাজ হারিয়ে রাঙাবেলিয়ায় ফিরে আসেন সুকুমার। স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে কোনও মতে দিন কেটে যাচ্ছিল। করোনার জন্য সরকারি সাহায্য তেমন কিছু না পেলেও এলাকায় লোকের বাড়িতে, জমিতে মাটি কেটে কোনও রকমে চলছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আমপান আসার খবর পেয়ে কোথাও যেন সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল পরিবারটি। আয়লার সেই ধ্বংসাত্মক স্মৃতি যেন আবারও সুকুমারের মনের কোণে উঁকি দিতে শুরু করেছিল। তাই বুধবার সকালেই স্ত্রী ও সন্তানকে নিজে ত্রাণ শিবিরে রেখে আসেন।

কিন্তু রক্ত জল করে তৈরি করা সাধের বাড়ি ছেড়ে আসতে মন চায়নি তার। তা ছাড়া ঘরে যেটুকু জামা-কাপড়, জিনিসপত্র রয়েছে তা নিয়ে ত্রাণ শিবিরে থাকা যায় না। তাই শ্যামলীকে বলেছিলেন, “চিন্তা করো না। আমাদের বাড়ির কিছু হবে না। আমি তো আছি। ঠিক সব কিছু সামলে রাখব।’’

এ দিকে ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা দিয়ে পঞ্চায়েত ও ব্লক প্রশাসনের মাইকে প্রচার শুনে স্বামীকে একা ঘরে থাকতে দিতে চাননি শ্যামলী। কিন্তু স্ত্রীর সেই বাধা উপেক্ষা করেই সুকুমার একা বাড়িতে থেকে যান। এ দিকে, সময় যত গড়াতে থাকে ততই বাড়তে থাকে হাওয়ার গতিবেগ। ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে বিদ্যাধরী ও গাড়াল নদীর জল। বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ শুরু হয় দমকা হওয়া। খানিকক্ষণের মধ্যেই ঘরের বেশ কয়েকটা চাল উড়ে যায়। ও দিকে, নদীর তীব্র গোঙানির আওয়াজ কানে আসতে থাকে সুকুমারের। বুঝতে পারেন বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতি হতে চলেছে। ঘর থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ত্রাণ শিবিরের দিকে যাবেন বলে ভাবছেন, ঠিক সে সময়ে বিকট শব্দ করে প্রবল জলোচ্ছ্বাস নদী বাঁধকে ভেঙে তছনছ করে গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে। গ্রামের যে যেখানে ছিলেন, সকলেই চিৎকার শুরু করেন, “বাঁধ ভেঙেছে, বাঁধ ভেঙেছে। যে যেখানে আছো, পালিয়ে এসো।’’

সেই চিৎকার শুনে সুকুমার ও সব কিছু ফেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। ততক্ষণে নদীর জল গ্রামের অনেকখানি ভিতরে চলে এসেছে। যে ক’জন গ্রামে ছিলেন, সকলেই ততক্ষণে গ্রামের উঁচু ইটের রাস্তার উপর আশ্রয় নিয়েছেন। গ্রামের মানুষজন গরু, বাছুর, ছাগল নিয়ে ইটের রাস্তা বরাবর হাঁটতে শুরু করেন ত্রাণ শিবিরের দিকে। কিন্তু প্রবল ঝড়ের মোকাবিলা করে সামনে এগোনো যাচ্ছিল না কিছুতেই। আর অন্য দিকে, নদীর নোনাজল দ্রুত যেন একের পর এক গ্রামকে গ্রাস করতে করতে ছুটে আসছিল। কোনও রকমে সকলে ত্রাণ শিবিরে পৌঁছে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

বৃহস্পতিবার সকালে সুকুমার গ্রামে ফেরেন। দেখেন চারিদিক জলমগ্ন। তবে একবুক জলের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সাধের তাজমহল। সেই জল পার হয়েই ঘরে যান তিনি। দেখেন ঘরের সব জিনিসই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে নদীর জলে। ঘরের অবস্থা ও খুবই খারাপ। যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে সেটি। সে দিন বুঝেছিলেন, বাড়ি ছেড়ে না পালালে হয় তো ভেসেই যেতেন নদীর জলে। দু’দিন ত্রাণ শিবিরে কাটিয়ে শনিবার থেকে আশ্রয় নিয়েছেন নদীবাঁধে। সেখানেই সরকারের দেওয়া একটা ত্রিপল দিয়ে কোনও রকম মাথা গোঁজার ঠাই করেছেন। সুকুমার বলেন, “আয়লার পর কোনও রকমে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। এই ঝড় আবার সব কিছু শেষ করে দিল। ভেবেছিলাম গ্রামে থেকেই কাজ করে সংসার চালিয়ে নেব। কিন্তু এখন যা হল আবারও কাজের খোঁজে বাইরের রাজ্যে যেতে হবে।” কিন্তু বাইরের রাজ্যে যাবেন কী করে? কাজই বা কী পাবেন। সর্বত্রই তো করোনা সংক্রমণের জেরে লকডাউন চলছে। শ্যামলী বলেন, “আপাতত ঈশ্বর ভরসা। আর কোনও দিন আমরা ঘর বাঁধতে পারব কিনা জানি না। এক জামাকাপড়ে এই দুধের শিশুকে নিয়ে কী ভাবে নদীর পাড়ে দিন কাটাব, বুঝতে পারছি না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown Cyclone Amphan Cyclone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy