Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Bagda

কেটেছে ভয়, বাঘরোল ভালবাসে পদ্মপুকুর

পদ্মপুকুর গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। কাঁটাতারের ওপারে বাংলাদেশে যশোর জেলার চৌগাছা এলাকা।

পদ্মপুকুর গ্রামে বাঘরোল। ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা পড়া ছবি।

পদ্মপুকুর গ্রামে বাঘরোল। ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা পড়া ছবি।

সীমান্ত মৈত্র
বাগদা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২০ ০০:৪৪
Share: Save:

গ্রামের মানুষকে দেখলে প্রাণ ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় না তারা। গ্রামবাসীও তাদের তাড়া করেন না। ভেড়ি থেকে মাছ শিকার করে। তবু এলাকার মানুষ চুপচাপই থাকেন। তাই গ্রামে নিশ্চিন্তে ঘোরাঘুরি করে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পশু বাঘরোল বা মেছোবিড়াল।

বাগদার সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম পদ্মপুকুরে বাঘরোল নিয়েই থাকেন গ্রামবাসী। কয়েক বছর আগে বাঘরোল বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় জায়গা পেয়েছে। আকারে ছোট হলেও বাঘের মতো দেখতে বলে মানুষ বাঘরোল দেখে ভয় পান। আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অনেক সময় তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।

পদ্মপুকুর গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। কাঁটাতারের ওপারে বাংলাদেশে যশোর জেলার চৌগাছা এলাকা। গ্রামবাসী জানালেন, মূলত সন্ধ্যার পর কাঁটাতার পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে গ্রামে ঢুকে পড়ে বাঘরোল। মাছ শিকার করে খেয়ে তারা ফিরে যায়। তবে বাঘরোল নিয়ে গ্রামবাসীর এই সচেতনতা বা ভালবাসা একদিনে তৈরি হয়নি। গ্রামের প্রৌঢ় কেতাব আলি মণ্ডল ও বনগাঁর একটি সংগঠনের সদস্যদের লাগাতার প্রচেষ্টার ফলেই এলাকার বাসিন্দারা বাঘরোল নিয়ে সচেতন হয়েছেন। নিজেরা তো বাঘরোলকে আঘাত করেনই না, উল্টে তাদের ভালবাসেন কেতবা আলিরা।

কী ভাবে গ্রামের এই পরিবেশ তৈরি হল?

গ্রামবাসী জানান, সাড়ে তিন বছর আগে গ্রামের এক যুবক দিনের বেলায় পাটখেতের ভিতর বাঘরোল দেখে ভয় পেয়ে যান। তিনি গ্রামে প্রচার করেন, বাঘ দেখেছেন। তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করেননি। কয়েকদিন পর এক ব্যক্তি ভোরে আজান দিতে যাওয়ার সময় বাঘরোল দেখেন। তিনিই গ্রামের সকলকে বলেন, ওই যুবক ভুল বলেননি, তিনিও বাঘ দেখেছেন। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন গ্রামবাসী। খবর দেওয়া হয় পুলিশ ও বিএসএফকে। গ্রামবাসীরা লাঠি নিয়ে রাত পাহারার ব্যবস্থা করেন। পুলিশ এসে ভরসা দেয়। ওই খবর পেয়ে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা বনগাঁর ওই সংগঠনের সদস্যেরা এলাকার লোকজনকে নিয়ে বৈঠক করেন। তাঁদের বোঝানো হয়, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যা দেখা গিয়েছে সেটি বাঘের মতো দেখতে হলেও বাঘ নয়, ওটি বাঘরোল।

পদ্মপুকুর, নওদা, চড়ুইগাছি এ সব গ্রামে অনেক মেছোভেড়ি রয়েছে। ভেড়ি থেকে মাছ চুরি হচ্ছিল। গ্রামবাসী চোর ধরতে জলাশয়ে কীটনাশক দেয়। মাছ খেতে এসে দু’টি বাঘরোল মারা যায়। গ্রামবাসী বুঝতে পারেন, সত্যিই তো এগুলি বাঘ নয়। এর পরেই গ্রামের মানুষকে বাঘরোল সম্পর্কে সচেতন করার কাজ শুরু করেন কেতাব। তিনি নিজে বাঘরোল সম্পর্কে জানতে শুরু করেন। তারপর গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে থাকেন। বাঘরোল নিয়ে মানুষকে বোঝাতে তিনি গ্রামে কয়েকবার বৈঠকেরও আয়োজন করিয়েছেন। কেতাব একটি মেছোভেড়ির মালিক। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামবাসীর মধ্যে থেকে বাঘরোল নিয়ে এখন ভয় কেটে গিয়েছে। বরং তাঁরা এখন বাঘরোল ভালবাসেন। বাঘরোলও হয়তো বুঝেছে সে কথা। তাই গ্রামবাসী দেখেও তারা পালিয়ে যায় না। কয়েক হাত দূরে দাড়িয়ে থাকে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘চোখে টর্চের আলো মারলেও বাঘরোল পালায় না। মেছো ভেড়ি পাহারা দিতে ভেড়ির পাশে আমার একটি ঘর আছে। সেখানে খাটে আমি শুয়ে থাকি, বাঘরোল খাটের নীচে এসে বসে থাকে। ভেড়ি থেকে মাছ ধরে খায়।’’ মাস খানেক আগেও গ্রামে একসঙ্গে ৬টি বাঘরোল দেখেছেন কেতাব। বনগাঁর ওই সংগঠনের সদস্যেরা গ্রামে ক্যামেরা লাগিয়ে বাঘরোলের গতিবিধি নজর রাখছেন। সংগঠনের সদস্য ধৃতিমান বিশ্বাস, সুভদ্রা বিশ্বাস, সুমি সিকদাররা এখন গ্রামে নিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন। দিন কয়েক আগে তাঁরা বাগদার মেছোভেড়ির মালিকদের নিয়ে বৈঠক করে বুঝিয়েছেন, বাঘরোল নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং তাদের ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হবে। কারণ, বাঘরোলের সংখ্যা ক্রমশ
কমে আসছে।

পদ্মপুকুর গ্রামে বাঘরোলের আনাগোনার কারণ ভেড়ি থেকে মাছ খাওয়ার লোভ। কেতাবদের বাঘরোল নিয়ে সচেতনতার কথা শুনে গ্রামে গিয়েছিলেন বনগাঁর এসডিপিও অশেষ বিক্রম দস্তিদার। তিনি বলেন, ‘‘বাঘরোল বাঁচাতে কেতাবেরা ভাল কাজ করছেন। এর ফলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ হচ্ছে।’’

অশেষ নিজেও সম্প্রতি বাঘরোল নিয়ে আয়োজিত সচেতনতামূলক কাজে সামিল হয়েছেন। ওই সংগঠন থেকে সম্প্রতি বনগাঁতে বাঘরোল বাঁচাতে সাইকেল মিছিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কেতাব বলেন, ‘‘গ্রামের মানুষের পাশাপাশি অন্য এলাকার মানুষকেও বাঘরোল নিয়ে বোঝাচ্ছি। ফলও মিলছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Bagda Civet Cat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE