আবেগ: বনগাঁ শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মতিগঞ্জের ঘড়ির মোড়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
বনগাঁ-বাগদা এবং সংলগ্ন এলাকা নিয়ে নতুন একটি জেলার ঘোষণা করা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে, ইছামতী। নামটি অনেকের পছন্দ হলেও বনগাঁ নামটি তুলে দেওয়া আবার অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের দাবি, বনগাঁ নামটির সঙ্গে দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের সুদীর্ঘ ইতিহাস, ভাবাবেগ জড়িয়ে আছে। ইছামতী কেবল বনগাঁ নয়, নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তা হলে কেন বনগাঁ জেলার নাম ইছামতী হবে, উঠছে এই প্রশ্ন।
স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে জানা গিয়েছে, বঙ্গদেশে নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে ১৮৬২ সালের শেষের দিকে নদিয়া জেলার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হর্সেল ও বারাসত জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট এ্যাসলে ইডেন বনগ্রামে আসেন। তাঁরা দুর্দশাগ্রস্ত নীলচাষিদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে বনগ্রামকে মহকুমা ঘোষণা করেন। ১৮৬৩ সালে নদিয়া জেলার একটি মহকুমা হিসেবে বনগ্রামের সৃষ্টি হয়। বনগাঁয় প্রথম মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন সি কুইনি। দ্বিতীয় ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন জে এন হার্ডলস। তৃতীয় মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সময়ে বিদ্যাসাগর বনগাঁয় এসেছিলেন। শ্রীশচন্দ্র ছিলেন গোবরডাঙা পুরসভার প্রথম চেয়ারম্যান। তিনিই প্রথম বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণায় বিধবা বিবাহ করেছিলেন।
১৮৮২ সালে বনগাঁ মহকুমা নদিয়া জেলা থেকে যশোহর জেলার অন্তর্গত হয়। ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার দিন বনগাঁ শহর কিন্তু ছিল পাকিস্তানের মধ্যে। প্রবীণ মানুষেরা জানালেন, ওই সময়ে মুসলিম লিগের পক্ষ থেকে শহরে উল্লাস প্রকাশ করে হয়েছিল। যদিও তার তিনদিন পরে ১৮ অগস্ট বনগাঁ মহকুমার বনগাঁ ও গাইঘাটা ভারতের ২৪ পরগনা জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।
শহরের বাসিন্দা, প্রাবন্ধিক বিশ্বজিৎ ঘোষ (পূর্ণ) বলেন, ‘‘জেলা হিসেবে বনগাঁ নামটা তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, বনগাঁর একটি নিজস্ব সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। দেশভাগ-মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী আমাদের বনগাঁ। আমরা যাঁরা এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, তাঁদের সঙ্গে বনগাঁর ভাবাবেগ জড়িত। বনগাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। বনগাঁ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-দীনবন্ধু মিত্রের। ইছামতী আমাদের অহঙ্কার ঠিকই, কিন্তু এই নদী নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত।’’
মানবাধিকার কর্মী দেবাশিস রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘প্রশাসনিক কাজে জেলা ভাগ ঠিক আছে। তবে বনগাঁ নামটা তুলে দেওয়া একদমই ঠিক নয়। যে ইছামতী সংস্কার হয় না, মরে যাচ্ছে— তার নামে জেলা ঘোষণা উপহাসের বিষয়।’’ কবি বিভাস রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘বনগাঁ নামটা চলে যাওয়া বেদনার। তবে আমাদের প্রধান নদীর নামে জেলা আমার পছন্দ হয়েছে।’’
অনেকেই আবার চাইছেন, ইছামতী ও বনগাঁ দু’টো নামই থাকুক। বনগাঁ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কুনাল দে বলেন, ‘‘নদীর নামে কোনও জেলা আগে হয়নি। ইছামতী নামটা ভাল। তবে আমি চাইব, জেলা হিসেবে ইছামতীর সঙ্গে বনগাঁ নামটিও যুক্ত থাকুক।’’
দেশভাগের সময়ে ওপার বাংলা থেকে অনেক মানুষ বনগাঁ শহরে চলে এসেছিলেন। স্থানীয় প্রবীণ মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে ও স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৪৯ সালে বাংলাদেশের বাগেরহাটে দাঙ্গার সময়েও দলে দলে মানুষ এখানে এসেছিলেন। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ওপার বাংলা থেকে শরণার্থী হিসেবে সব থেকে বেশি মানুষ এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
৭১ সালে যুদ্ধের সময়ে শহরে ভারতীয় সেনা ক্যাম্প করেছিল। বনগাঁ স্টেডিয়ামে সেনারা কামান এনে রেখেছিলেন। সাঁজোয়া গাড়ি যাতায়াত করত। যুদ্ধবিমান উড়ত। এই আবেগও বনগাঁর সঙ্গে যুক্ত।
বাসিন্দাদের বক্তব্য, বনগাঁ নামে ইতিমধ্যেই পুলিশ জেলা হয়েছে। বনগাঁ নামে লোকসভা কেন্দ্র হয়েছে। দু’টি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক জেলার নাম বনগাঁ। তা হলে কেন বনগাঁ নাম তুলে দেওয়া হবে?
যুক্তিবাদী মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক প্রদীপ সরকার বলেন, ‘‘বনগাঁ জেলা নাম থাকুক। বনগাঁর ঐতিহ্য ও প্রাচীন সংস্কৃতি আছে। বনগাঁ নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক-বাহক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy