প্রধানের প্যাডে ছাপানো তাঁর স্বামীরও ফোন নম্বর। নিজস্ব চিত্র
পঞ্চায়েত প্রধানের নাম জানেন?
প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ একবারও না ভেবে জবাব দিলেন, কেন? হঠাৎ এ প্রশ্ন? না মানে, জানতে চাইছিলাম, একটা কাজে এসেছি। বৃদ্ধের উত্তর, ‘আফজল।’
বাগদা ব্লকের মালিপোতা পঞ্চায়েত এলাকায় কেবল ওই বৃদ্ধ নন, অনেকেই প্রধান হিসাবে চেনেন তৃণমূল নেতা আফজল আলি মণ্ডলকে। যদিও প্রধান আফজল নন, তাঁর স্ত্রী আসমাতারা মণ্ডল।
বাসিন্দারা জানালেন, প্রধানের কাজকর্ম সামলান তাঁর স্বামী। অভিযোগ, প্রধান নিয়মিত পঞ্চায়েত অফিসে না এলেও তাঁর স্বামী নিয়মিত আসেন। মানুষের অভাব-অভিযোগের কথা আফজলকেই বলেন। বকলমে তিনি প্রধান হিসাবে কাজ করেন বলে জানালেন গ্রামের অনেকে।
আফজল অবশ্য বলেন, ‘‘স্ত্রী কোনও কিছু বুঝতে না পারলে পরামর্শ করেন আমার সঙ্গে। তবে এখন আর প্রধানকে সাহায্য করার প্রয়োজন হয় না। স্ত্রী শিক্ষিত মেয়ে। নিজেই সব কাজকর্ম করতে পারেন।’’
স্থানীয় মথুরা গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকেই জানালেন, প্রধানকে তাঁরা গ্রামে আসতে না দেখলেও তাঁর স্বামীকে আসতে দেখেছেন কয়েকবার।
পঞ্চায়েতের শংসাপত্রে প্রধানের ফোন নম্বর হিসাবে দু’টি নম্বর দেওয়া আছে। বাসিন্দারা জানালেন, দু’টি নম্বরের একটি প্রধানের স্বামীর। ফোন করলে তাঁর স্বামী ধরেন। প্রধানকে ফোনে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ। আফজলের কথায়, ‘‘দুটো নম্বরই আমাদের। দু’জনে ব্যবহার করি। আলাদা করে কোনও ফোন নম্বর নেই।’’
দিন কয়েক আগে রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েতের সব স্তরেই মহিলাদের জন্য নির্ধারিত আসন সংখ্যা বাড়িয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, পঞ্চায়েতস্তরে মহিলা সদস্যদের অনেকের ক্ষেত্রেই কাজকর্ম বকলমে তাঁদের স্বামীরাই পরিচালনা করেন। গ্রামের মানুষও পঞ্চায়েত প্রধান বা সদস্য হিসাবে তাঁদের স্বামীদেরই চেনেন।
বনগাঁ ব্লকের বৈরামপুর পঞ্চায়েতের প্রধান হিসাবে এলাকার বেশিরভাগ মানুষ চেনেন হায়দার আলি মোল্লাকে। খাতায়-কলম প্রধান হায়দারের স্ত্রী তনুজা খাতুন মোল্লা। অভিযোগ, প্রধানের যাবতীয় কাজকর্ম হায়দারই করেন। তিনি পঞ্চায়েতে অফিসে আসেন। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার আছে। মানুষ প্রয়োজনে হায়দারের কাছেই যান। প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ হিসাবে হায়দারের ফোন নম্বর মানুষকে দেওয়া হয়।
যদিও হায়দার বলেন, ‘‘প্রধানের প্রশাসনিক কাজকর্ম স্ত্রী সামলান। মানুষের সমস্যা মেটান। আমি দলের কাজে ব্যস্ত থাকি। প্রাক্তন প্রধান হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা আছে। প্রধান প্রয়োজন হলে পরামর্শ নিয়ে থাকেন। তাঁকে মৌখিক পরামর্শ দিই।’’
বাগদার হেলেঞ্চা পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের চায়না বিশ্বাস। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পঞ্চায়েত প্রধানের অনেক কাজ তাঁর স্বামী অনির্বাণ ওরফে ঝন্টুই সামলান। স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই অবশ্য সক্রিয় ভাবে দেখা যায়।
এ বিষয়ে চায়না বলেন, ‘‘স্বামী সহযোগিতা করেন। কোথাও যেতে হলে স্বামীর বাইকে যাই। গাড়িতে গেলে স্বামীই গাড়ি চালান। পঞ্চায়েতের কাজ আমি নিজে করি। তবে স্বামীকে কোনও দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি করে দেন।’’
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেবল প্রধান নন, পঞ্চায়েত সদস্য, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য, জেলা পরিষদ সদস্য অনেক মহিলারই প্রশাসনিক কাজকর্ম স্বামীরা দেখেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আসন সংরক্ষণের ফলে স্বামী দাঁড়াতে পারেননি। সেখানে স্ত্রীদের প্রার্থী করা হয়। সাংবাদিকেরাও কোনও বিষয়ে মহিলা প্রধানের বক্তব্য আনতে গেলেও তাঁদের স্বামীরা বক্তব্য দেন।
এ নিয়ে মানুষের ক্ষোভ আছে। এক ব্যক্তির কথায়, ‘‘যাঁকে ভোট দিয়ে জেতানো হল, তিনি ভোটে জিতে কাজ করেন না। স্বামীরা কাজ করেন।’’ অভিযোগ, শংসাপত্রে মহিলা প্রধানের সইও কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বামীই করে দেন। প্রশাসনিক বৈঠক ছাড়া কোনও কোনও মহিলা পঞ্চায়েত প্রধান অফিসে আসেন না।
তবে ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, বাগদা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গোপা রায়। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, ‘ডোন্ট থিঙ্ক টু বিট মি, বিকজ আই অ্যাম আ গার্ল।’ গোপার কথায়, ‘‘মহিলা হিসাবে আমি নিজের মনের জোরের কথা বলেছি। কাজের ক্ষেত্রে আমাকে হারানো যাবে না। সেটাই বলতে চেয়েছি।’’
গোপার কাজে স্বামী প্রেমপ্রসাদ রায় হস্তক্ষেপ করেন না বলে জানা গেল। প্রেমপ্রসাদ সমিতিতে কার্যত যান না। গোপার কথায়, ‘‘মহিলা হিসাবে কাজ করতে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। মহিলারা কাজে ফাঁকি দেন না। তাঁরা পরিশ্রমী, দুর্নীতিপরায়ণ নয়। সে কারণে মহিলাদের আরও বেশি করে জনপ্রতিনিধি হওয়া উচিত।’’
বাগদা ব্লকের আষাঢ়ু পঞ্চায়েতের প্রধান সরস্বতী মুন্ডা ভোর ৪টেয় ঘুম থেকে উঠে গোয়াল থেকে গরু-বাছুর বের করে খেতে দেন। উঠোন ঝাঁট দেন। রান্না করেন। বাড়িতে মানুষ এলে কথা বলেন। শংসাপত্র দেন। তাঁর স্বামী দিলীপ পঞ্চায়েতে আসেন না। সরস্বতী বলেন, ‘‘অটো ভাড়া বাঁচানোর জন্য স্বামীকে ডেকে নিই। বাইকে করে বাড়ি ফিরি। এর বাইরে উনি পঞ্চায়েতে আসেন না।’’
গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ইলা বাগচি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী তিনি। মিটিং-মিছিলে নেতৃত্ব দেন। পঞ্চায়েত স্তরে মহিলাদের আসন সংরক্ষণকে সমর্থন করে ইলা বলেন, ‘‘মহিলা জনপ্রতিনিধিরা আরও বেশি করে ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতে পারেন। হেঁসেলেও তাঁদের যাতায়াত। অভাব-অভিযোগের কথা সহজে তাঁদের কানে আসে। পুরুষ জনপ্রতিনিধিদের সেই সুযোগ নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy