জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। —ফাইল চিত্র।
বালু আর নেই সে বালু!
গত কয়েক বছরে বালু বা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নিম্নমুখী রেখচিত্রকে এই ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের লোকজন। তাঁরা বলছেন, যে বালুদার (জ্যোতিপ্রিয়) চোখ দিয়ে এক সময়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাকে চিনতেন দিদিমণি (তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়), দলে তাঁর গুরুত্ব যেন কমতে শুরু করে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে। তাঁকে ঘিরে যে বলয়টি তৈরি হয়েছিল, যেখানে ছিলেন বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য ওরফে ডাকুদা, সন্দেশখালির শেখ শাহাজাহানেরা, তাঁদেরও যেন উত্তাপ কমতে থাকে। যার শেষ বালু ও শঙ্করের গ্রেফতারি এবং শাহজাহানের লুকিয়ে থাকায়।
কেন এবং কী ভাবে এই পতন? জেলা তৃণমূলের অনেকেই একান্ত আলোচনায় বলছেন, এই সমীকরণ বদলাতে শুরু করে ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের পর থেকে। দলের অন্দরে গুঞ্জন আছে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছাতেই ‘প্রবীণ’ বালুকে খাদ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তুলনায় ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ বন দফতরের মন্ত্রী করা হয়। সংগঠনেও প্রভাব কমতে থাকে তাঁর। একই সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের অনেকের ডানা ছাঁটা শুরু হয়।
২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের পরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব জেলায় বনগাঁ, দমদম-ব্যারাকপুর, বসিরহাট, বারাসত— এই চারটি সাংগঠনিক জেলা তৈরি করেন। সাংগঠনিক জেলায় আলাদা আলাদা সভাপতি করা হয়। একক ভাবে জেলা সভাপতির পদ যায় বালুর। তার পর থেকে বালু জেলা রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরেছিলেন বলে জানাচ্ছে দলেরই একটি সূত্র। পঞ্চায়েত ভোটেও সে ভাবে গা ঘামাতে দেখা যায়নি। জনসভায় গেলেও কার্যত বক্তৃতা করেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, বক্তব্য দেওয়ার জন্য তিনি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে এগিয়ে দিয়েছেন।
এর মধ্যেই জেলায় প্রভাব বাড়তে শুরু করে সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক, জেলা সভাধিপতি নারায়ণ গোস্বামী, দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু, তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসেদের। দলের অন্দরে এঁরা সকলেই অভিষেক-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
বালুই নন, শঙ্করেরও গুরুত্ব কমতে শুরু করে। তাঁকে পুর প্রশাসকের পদ এবং বনগাঁ শহর তৃণমূল সভাপতির পদ থেকে সরানো হয়। গত পুরভোটে দল তাঁকে টিকিটও দেয়নি। গোপাল শেঠকে তুলে আনা হয় পুরসভার দায়িত্বে। সম্প্রতি ইডির হাতে তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের কেউ শঙ্করের পাশে দাঁড়িয়েছেন— এই মর্মে কোনও বিবৃতি সামনে আসেনি। উল্টে তৃণমূলের জেলা কোর কমিটির চেয়ারম্যান, পানিহাটির বিধায়ক নির্মল ঘোষ বলেন, ‘‘শঙ্করের দলে এবং সাংগঠনিক পদে কী অবস্থান, তা আমার জানা নেই। আমি জানতে চেয়েছি।’’
জ্যোতিপ্রিয় ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে জেলার বেশির ভাগ অংশে তৃণমূলের সভা-মিটিং-মিছিলে বালুর ছবি থাকছে না। বক্তারা অনেকে তাঁর নামও মুখে আনছেন না। বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডলের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে।
ব্যতিক্রম হাবড়া। সেখানকার নেতারা নানা ভাবে ‘বালুদা’র পাশে
থাকার বার্তা দিয়েছেন। তবে চাকলায় জেলা তৃণমূলের কর্মিসভার
মঞ্চে দাঁড়িয়ে বালু প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাঁর পাশে থাকার বার্তা দেন
মমতা।
লোকসভা ভোটের আগে বালু জামিন পাবেন না— তা ঘরোয়া আলোচনায় মোটামুটি ধরেই নিয়েছেন তৃণমূলের জেলা নেতারা। হাবড়ার পুরপ্রধান নারায়ণচন্দ্র সাহা বলেন, ‘‘বালুদা আমাদের অভিভাবকের মতো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবশ্য তাঁকে ছাড়া ভোটের লড়াইয়ে নামতে হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি আমাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে গিয়েছেন।’’
নির্মল ঘোষ বলেন, ‘‘বালু আর আমি ছিলাম দলের সব সময়ের কর্মী। বালু না থাকাটা দলের ক্ষতি। তবে আমরা সকলে মিলে সেই ক্ষতি মেরামত করে পাঁচটি লোকসভা আসনেই দলকে জয়ী করতে পারব।’’
এই নিয়ে কটাক্ষ করেছে বিরোধীরা।
শুক্রবার মেখলিগঞ্জে গিয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘এখানেও বালু বাকিবুরের মতো হালু বালু-রা রয়েছে। খাদ্য নিগমের ভাল চালগুলো চ্যাংরাবান্ধা দিয়ে বাংলাদেশে পাচার করছে। শাহাজাহান শেখ নৌকা করে চাল পাচার করে বাংলাদেশের সাতক্ষীরাতে। এদিকেও খোঁজ করলে দেখবেন বাংলাদেশে ভারতের খাদ্য নিগমের চাল পাওয়া যাচ্ছে। ভাল চাল সব চোর তৃণমূল পাচার করে দিচ্ছে। খারাপ চাল আর আটা আপনাদের দিচ্ছে। আপনারা দেখবেন প্রধানমন্ত্রী অন্ন সুরক্ষা যোজনা ছোট করে লেখা আছে, কিন্তু বড় করে হাড়ির ছবি দিয়ে খাদ্য সাথী লেখা আছে। ওটা মমতা বন্দ্যোপাধয়ারে চিহ্ন। সব জায়গায় স্টিকার। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার ওপরে স্টিকার। খালি মিথ্যে কথা।
বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডলের কথায়, ‘‘চোরেদের জায়গা জেলে। বালু এবং শঙ্কর যে জেলে যাবেন, তা বুঝতে পেরেই দল ওঁদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছিল। তবে জেলায় বালু ঘনিষ্ঠ আরও অনেক নেতার ওঁর সঙ্গে জেলেই ঘর করতে যাবেন। তার আর দেরি নেই।’’
অশোকনগরের প্রাক্তন বিধায়ক, সিপিএম নেতা সত্যসেবী করের কথায়, ‘‘ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে তৃণমূল। ওদের পরিণতি শেষের দিকে এগোচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy