পাশে-আছি: নিশিবন্ধুদের দল। অশোকনগরে। ছবি: সুজিত দুয়ারি
ছেলে কর্মসূত্রে বাইরে। মেয়েরও বিয়ে হয়েছে দূরে। বাড়িতে শুধুমাত্র তাঁরা দু’জন। রাতে তাই বৃদ্ধের বুকে যন্ত্রণা শুরু হতে চোখে অন্ধকার দেখেছিলে বৃদ্ধা। পরিচিত কয়েকজনকে ফোন করেও সাড়া পাননি। সকালে পরিচিতদের সাহায্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বৃদ্ধকে। এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই রাতের কথা মনে বলে এখনও ভয়ে বুক কাঁপতে থাকে দম্পতির।
শুধু ওই বৃদ্ধ নন, এমন অনেক ঘটনাই ঘটে সর্বত্র। এ বার বাড়িতে একা থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এমন সমস্যা দূর করতে এগিয়ে এল অশোকনগরের একটি সংগঠন। নাম, হৃদয়ে অশোকনগর। অশোকনগর বিধানসভা এলাকার প্রায় দেড়শো যুবক একত্রিত হয়ে এই সংগঠন তৈরি করেছেন। রবিবার তাঁরা প্রজাতন্ত্র দিবসে পথ চলা শুরু করেন। ওই দিন থেকেই তাঁরা ‘নিশিবন্ধু’ হিসাবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। নিজেদের ফোন নম্বর তাঁরা লিফলেটে ছেপে এলাকায় এলাকায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। এখন থেকে অশোকনগর বিধানসভা এলাকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা রাতে শারীরিক কোনও সমস্যায় পড়লে ওই যুবকদের দেওয়া ফোন নম্বরে বা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলেই তাঁরা পৌঁছে যাবেন বাড়িতে। রবিবারই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ওই নম্বরে ফোন করছেন। কেউ আবার হোয়াইটঅ্যাপও করছেন। যুবকেরাও তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছেন দ্রুত।
এখন কর্মসূত্রে অনেকের ছেলেমেয়েরাই বাইরে থাকেন। অনেকের মেয়ের দূরে বিয়ে হয়। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মাকে থাকতে হয় একাই। কোনও সমস্যায় পড়লে ছেলেমেয়েদের আসতে যে সময় লাগে, তাতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতেই পারে। ওই যুবকেরা মনে করেন, এমন সময়ই মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বিশেষ করে রাতে ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদের দেখার কেউ থাকেন না। এমনকী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া তাঁদের রাত কাটাতে হয়।
সংগঠনের সম্পাদক তপন ভৌমিক বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আমরা পরিষেবা দিচ্ছি। বছরের ৩৬৫ দিনই এই পরিষেবা চালু থাকবে। আমরা মূলত রাতে অসুস্থ হয়ে পড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাড়ি গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করা, চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি করার কাজ করছি।’’ তবে যে সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সন্তান প্রতিষ্ঠিত তাঁদের থেকে শুধু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া নেওয়া হবে। যাঁদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, তাঁদের কাছ থেকে কোনও টাকা নেওয়া হবে না বলে জানান তিনি। সমস্ত খরচ চালানো হচ্ছে সদস্যদের চাঁদায়।
তপন বলেন, ‘‘শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিতে আসতে চাইছেন না। তবে তাঁরা সমাজের জন্য কিছু করতে চান। প্রথমে তাঁদেরকে আমরা একত্রিত করেছি। তারপর চিন্তাভাবনা করে দেখেছি কোন কাজগুলি রাজনৈতিক দলগুলির নজর এড়িয়ে যায়। সরকার থেকে সে গুলি করা সম্ভব হয় না। সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করত গিয়ে রাতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’’
অশোকনগর বিধানসভার বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের সদস্যেরা রয়েছেন। তাঁদের নেতৃত্বে ওই সব এলাকায় যুবকেরা কাজ করবেন। ডিসেম্বর মাসে হাট ন’পাড়া এলাকায় এক বৃদ্ধ দম্পতি নিজের বাড়িতে খুন হন। বাড়িতে তাঁরা একাই ছিলেন। অনেক সময় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বাড়ি তালা দিয়ে বেড়াতে বা কাজে যান। সেই সুযোগে চুরি হয়।
তপন বলেন, ‘‘বাড়ি ফাঁকা থাকলে আমাদের জানালে আমরা বাড়িটির উপর নজর রাখব। রাতে কেউ নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে আমরা সাহায্য করব।’’
পুলিশ এর প্রশংসা করেছে। অশোকনগর থানার ওসি অয়ন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পুলিশের গাড়ি দিয়ে বা পুলিশের উপস্থিতি দিয়ে আমরা যুবকদের সাহায্য করব।’’ অশোকনগরের বিধায়ক ধীমান রায় বলেন, ‘‘যুবকেরা একটা মহৎ কাজ করছেন। আমার ২৪ ঘণ্টা ফোন খোলা থাকে। আমিও ওঁদের সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত।’’ প্রবীণ মানুষেরা খুশি। তাঁদের কথায়, ‘‘এর ফলে নিজেদের আর নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে না। এখন থেকে আতঙ্ক ছাড়া বসবাস করতে পারব।’’ সংঠনের সভাপতি সঞ্জয় দাস বলেন, ‘‘আমরা স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও টোটো, অ্যাম্বুল্যান্স ও গাড়ি চালকেরাও আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy