বিশ্বরূপের পড়ার ঘর, দিনের আলোয় পড়াশোনা। নিজস্ব চিত্র
ছোট কথা বলার ফোনে চার্জ করার মূল্য পাঁচ টাকা। বড় অ্যান্ড্রয়েড ফোনে চার্জে লাগে দশ টাকা। আর স্মার্টফোনের চার্জ বাবদ লাগে কুড়ি টাকা। এ ছাড়াও, ব্যাটারিচালিত ইমার্জেন্সি আলো চার্জ দেওয়ার জন্যও নির্দিষ্ট মূল্য ধার্য করা রয়েছে।
পনেরো বছর আগে জেনারেটর কিনেছিলেন অরুণ দাস। সেই জেনারেটর থেকে গ্রামের লোকের মোবাইল চার্জ দেওয়ার বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন মানুষটি। গোটা একটা দ্বীপের মানুষের মোবাইল ফোন চালু রাখার ক্ষেত্রে অরুণবাবুর ছোট জেনারেটরটিই একমাত্র ভরসা। কারণ, গোটা দ্বীপ এখনও বিদ্যুৎসংযোগহীন।
জায়গার নাম সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমা ব্লকের জি প্লট। ঝড়ে বৈদ্যুতিক সংযোগের তার, পোস্ট সব মাটিতে মিশে গিয়েছে। নদী পেরিয়ে যে সব বিদ্যুতের তার ঢুকেছিল গ্রামের ভিতর, সেই সব আমপানের কবলে চলে গিয়েছে। ফলে, আমপানের পর থেকে গোটা দ্বীপে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই। শুধু তাই নয়, গ্রামের স্থানীয় মানুষজনের আশঙ্কা, আগামী মাস ছ’য়েকের আগে ফের নতুন করে বিদ্যুৎসংযোগ গ্রামে ফেরার কোনও সম্ভাবনাও নেই।
অরুণবাবু বলেন, ‘‘আমি জেনারেটর ভাড়া দিতাম বিয়েবাড়ি বা কোনও অনুষ্ঠান বাড়ির কাজে। কিন্তু ঝড়ে আলো চলে যাওয়ার পর গ্রামের মানুষ খুব বিপদে পড়েছেন। রোজ পঞ্চাশ থেকে ষাট জন আসেন মোবাইল ফোনে চার্জ দিতে। এটাই এখন আমার রোজগার।’’ তিনি জানান, বুদ্ধি করে পনেরো বছর আগে পঁচিশ হাজার টাকায় জেনারেটর কিনেছিলেন। তা লকডাউন, আমপানে কাজে দিয়েছে।
আমপানের পর কেটে গিয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ। ঘরবাড়ি, রাস্তা থেকে আস্তে আস্তে জল সরছে। মাঠে, পুকুর-ঘাটে, চাষের জমিতে এখনও নোনা জল। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন গ্রামের মানুষজন। ক্ষতিপূরণের টাকা কবে পাবেন, সে আশায় না থেকে নিজেরাই ঘর-বাড়ি মেরামতে হাত লাগিয়েছেন। কেউ মাটি কেটে বাঁধের সারাই করছেন। কোথাও পুকুর থেকে নোনা জল সেঁচে ফলে বৃষ্টির মিষ্টি জল ধরে রাখার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু যে কাজটা একেবারেই নিজস্ব উদ্যোগে করা সম্ভব নয়, সেটা হল গ্রামে বিদ্যুৎসংযোগ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা।
জি প্লটের স্থানীয় গ্রামগুলিতে বিদ্যুৎসংযোগ এসেছে বছর দু’য়েক আগে। তার আগে মানুষ আলো-হাওয়া জীবনেই অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু আলো আসার পরে অনেকেই আশায় ছিলেন ছেলেমেয়ের পড়াশোনায় সুবিধে হবে। আশা করে অনেকে কলকাতা শহরেও পড়তে পাঠিয়েছেন।
যেমন, কৃষ্ণদাসপুর গ্রামের বিশ্বজিৎ সর্দার। যাদবপুরের ইন্টারন্যাশনাল রিলেসনশিপ-এর ছাত্র তিনি। বিশ্বজিৎ বলছেন, ‘‘আমার কলেজের অনলাইন প্রোজেক্টের কাজ করতে পারছি না। পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে গেল অনেক। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ছিলাম। করোনার কারণে এখন ওখানেও থাকতে পারছি না। বাড়ি এসে পড়েছি বিপদে। টানা কারেন্ট নেই। মোমবাতি জ্বেলে যেটুকু পারছি পড়াশোনা করছি। মোবাইলে যে অনলাইন প্রোজেক্টের জিনিসপত্র লেখালেখি করব, তা-ও তো চার্জ থাকছে না। মাঝে মাঝেই ফোন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’’
তিনি জানাচ্ছেন, এলাকার ছেলেমেয়েরা এত দিন সোলার আলোয় যতটুকু পারত, কাজ চালিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু ঝড়ে সে সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাইরে থেকে ও প্রশাসনিক ভাবে বেশ কিছু সোলার আলো দেওয়া হয়েছে। তবে আলো-পাখা বা মোবাইল চলার মতো সুবিধা নেই।
বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘শহর থেকে ফিরে মাকে মাঝে মাঝে বাড়ির কাজে সাহায্য করতে যাই। অন্ধকারে রান্না করা, ঘরের কাজ করা— যেগুলো মা সারা বছর করে থাকেন। ওই এক দিনেই বুঝতে পারি, এই ভাবে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় সংসারের কাজ সারা কতটা কঠিন। আমার তো কলকাতা থেকে সুন্দরবনে এসে এখন অসুবিধা হয়।’’ তার উপরে রয়েছে রাতের বেলা সাপ, পোকামাকড়ের উপদ্রব। তবে এত গ্রামে এত অন্ধকারের মাঝেও দুটো বাড়িতে সন্ধের পর আলোটুকু জ্বলে, যাঁদের ঘরে জেনারেটর আছে।
এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার দক্ষিণ ২৪ পরগনার রিজ়িওনাল ম্যানেজার অনুপ মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এই দ্বীপগুলিতে নদীর উপর দিয়ে টাওয়ারের মাধ্যমে বিদ্যুৎসংযোগ পৌঁছয়। অন্য সব জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি বা তার সারাইয়ের কাজ দ্রুত গতিতে হলেও মৌসুনি দ্বীপ ও জি প্লটে সে কাজ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, ওখানে ঝড়ে টাওয়ার পড়ে গিয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ পৌঁছনো যাচ্ছে না। এই কাজ স্থানীয় ভাবে বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীদের দিয়ে করানো সম্ভবও নয়। আমরা আশা করছি, আগামী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সেই টাওয়ার সারাইয়ের কাজ করে ফেলতে পারব। ইতিমধ্যে আমরা জি প্লটের ভিতরে বিদ্যুতের খুঁটি, তার সারানোর কাজ এগিয়ে রাখছি, যাতে টাওয়ার দাঁড় করানো গেলেই মানুষকে বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। এই জন্য সামনের সপ্তাহে আমাদের টিমের লোক জি প্লটে পৌঁছবে। মৌসুনি দ্বীপে ইতিমধ্যে সে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।’’
তাঁর আশা, আরও ছ’মাস মানুষকে কষ্ট করতে হবে না। খুব শীঘ্রই ফের আলো জ্বলবে বিশ্বজিৎদের কাঁচামাটির ঘরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy