Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

চাঁদা চেয়েই দমাদ্দম মার গাড়িতে

কোথাও লাঠিসোঁটা নিয়ে গাড়ি আটকে জুলুম, গাড়ির উপরে দুম দুম করে পড়ছে চাঁদা শিকারিদের লাঠির ঘা, কোথাও মনপসন্দ চাঁদা না পেয়ে গাড়ির হাওয়া খুলে দিচ্ছে বেয়াড়া ছেলের দল— চাঁদার জুলুম এ ভাবেই চলছে ক্যানিং, কাকদ্বীপ মহকুমার নানা রাস্তায়।

ক্যানিং-বারুইপুর রোডে যুবকদের তাণ্ডব। নিজস্ব চিত্র।

ক্যানিং-বারুইপুর রোডে যুবকদের তাণ্ডব। নিজস্ব চিত্র।

সামসুল হুদা ও শান্তশ্রী মজুমদার
ক্যানিং ও কাকদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৩০
Share: Save:

কোথাও লাঠিসোঁটা নিয়ে গাড়ি আটকে জুলুম, গাড়ির উপরে দুম দুম করে পড়ছে চাঁদা শিকারিদের লাঠির ঘা, কোথাও মনপসন্দ চাঁদা না পেয়ে গাড়ির হাওয়া খুলে দিচ্ছে বেয়াড়া ছেলের দল— চাঁদার জুলুম এ ভাবেই চলছে ক্যানিং, কাকদ্বীপ মহকুমার নানা রাস্তায়।

ক্যানিং ১, ২ বাসন্তী, গোসাবা ব্লক এলাকায় সব মিলিয়ে ২৪০টির মতো পুজো হচ্ছে। এগুলির সরকারি অনুমোদন আছে। কিন্তু বহু জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তোলার অভিযোগ উঠছে গত ক’দিন ধরেই। কোথাও রাস্তার উপরে আড়াআড়ি বাঁশ ধরে চাঁদার বিল ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও বেপরোয়া যুবকের দল হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তুলছে। টাকার অঙ্কের মাথা-মুণ্ড নেই। ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০-২০০ টাকাও চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এবং এটা যে শুধু একটা পয়েন্টে, তা নয়। একই রাস্তার বিভিন্ন অংশে ছেলের দল চাঁদার জুলুম চালাচ্ছে। ফলে গাড়ি নিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ পেরোতে গুণাগার দিতে হচ্ছে বেশ কয়েকশো টাকা। ছোট গাড়ি হলে চাঁদা কম, ভারী ট্রাক হলে চাঁদার পরিমাণ বেশি।

ক্যানিং-বারুইপুর রোড, বাসন্তী হাইওয়ের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এ ভাবেই জোর করে কালীপুজোর চাঁদা আদায় হচ্ছে। টাকা দিতে না চাইলে জুটছে গালাগালি। গাড়ির চাবি কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। কোথাও কোথাও চালককে চড়-থাপ্পর মারার মৌখিক অভিযোগ উঠলেও পুলিশের কাছে এখনও সে সব নথিভুক্ত হয়নি।

ক্যানিঙের এক গাড়ির মালিক প্রশান্ত ঘোষ বলেন, ‘‘রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে হয়রান হতে হচ্ছে। চাঁদা দিতে না চাইলে গালাগালি, ধাক্কাধাক্কিও করা হচ্ছে।’’ এক ট্রাক চালকের কথায়, ‘‘পনেরো-ষোলো বছরের সব ছেলে। ২০০ টাকা চাঁদা চাইল। ৫০ টাকা দেবো বলেছিলাম। ওরা গাড়িতে দমাদ্দম লাঠির বাড়ি মারল। গাড়ির কেবিনে উঠে ধাক্কাধাক্কি শুরু করল। চাবি কেড়ে নিল। শেষে দেড়শো টাকায় রফা হল।’’ পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালেন না কেন?

প্রবীণ ট্রাক চালকের কথায়, ‘‘এ তো প্রতি বছরের সমস্যা। পুলিশ কি আর কিছু জানে না? অভিযোগ জানিয়ে লাভ হবে না ভেবেই আর থানা-পুলিশ করিনি। ট্রাকের মালিকও সে কথাই বললেন। তা ছাড়া, আবার তো এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে হবে, শেষে যদি ওরা জানতে পেরে মারধর করে!’’

স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, পুলিশি নজরদারি না থাকার জন্যই এই পরিস্থিতি।

মহকুমা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘যান নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদার জুলুম রুখতে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে নজরদারি ও নাকা চেকিং করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জন জোর করে চাঁদা আদায়ের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।’’

চাঁদার জুলুমের চিত্র খতিয়ে দেখতে গিয়ে কাকদ্বীপ থানার সীমাবাঁধ এলাকা পৌঁছনো গিয়েছিল। দেখা গেল, গণেশনগর এলাকায় ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে ছোট গাড়ি, লাইন বাস থেকে শুরু করে মালবাহী গাড়ি— কারও ছাড় নেই। রীতিমতো গাড়ি আটকে রাস্তায় যানজট করে চলছে চাঁদা আদায়। পান ও মাছ ব্যবসায়ীরা পড়েছে মহা সমস্যায়। লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে যাওয়ার দশা তাঁদের। সময়ে বাজার ধরতে হবে, তা না হলে মাছও পচে যাচ্ছে। পথে দেরি হওয়ায় পানের ঝুড়িও ঠিক মতো রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছচ্ছে না কাকদ্বীপ থেকে। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় চাঁদার জুলুমের জেরে দেরি হচ্ছে অনেকটাই। তার উপর চাঁদা গুণতে গিয়ে লাভের অঙ্কে টান পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাবের জেরে ক্ষুব্ধ ওই দুই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একটা বড় অংশ।

দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি বৈঠকে পুলিশকর্তা, প্রশাসন, ক্লাব প্রতিনিধি সকলকে নিয়ে বৈঠক করে এই সমস্যার কথা আলোচনা করা হয়েছিল। রাস্তা আটকে চাঁদা তুলতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু বিশ্বকর্মা পুজো থেকে শুরু করে জগদ্ধাত্রী পুজো পর্যন্ত— প্রতি বছরই এই সমস্যা চলে বলে জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।

পশ্চিমবঙ্গ ইউনাইটেড ফিসারমেন অ্যাসোশিয়েশনের নেতা বিজন মাইতি বলেন, ‘‘নামখানা থেকে নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত অন্তত ১০টি জায়গায় ৩০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার জুলুমে মাছের গাড়ি পৌঁছতে দেরি হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে বলেছি। ব্যবস্থা না হলে আমাদের পথে নামতে হবে।’’ মাছের গাড়ি দীর্ঘক্ষণ পথে আটকে রেখে চাঁদা নেওয়ার জেরে পাইকারি বাজারে তা ঢুকতে অনেকটা সময় দেরি হচ্ছে বলে মাছের দর পড়ছে বলে দাবি করছেন তাঁরা। অভিযোগ, চাঁদার জুলুমের জেরে ডায়মন্ড হারবার, শিয়ালদা, এবং হাওড়া মাছ বাজারেও জেলার অনেক অংশ থেকে মাছ পৌঁছচ্ছে দেরিতে।

একই সমস্যা পান চাষিদের ক্ষেত্রেও। নামখানা কাকদ্বীপ জুড়ে পানের ফলন ভাল। এখান থেকেই পান পাড়ি দেয় রাজ্যের অন্যান্য এলাকায়। কালীপুজোর আগে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় একেবারেই সন্তুষ্ট নন পানচাষিরা।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পানচাষি সমিতির নেতা হরিপদ সামন্তের কথায়, ‘‘প্রশাসনের কাছে গেলে নানা ঝামেলায় উল্টে চাষিকেই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’’ কাকদ্বীপ পানের আড়তের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীও এ কথা মেনে নিয়েছেন।

কাকদ্বীপ মহকুমার ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে কাকদ্বীপ থানা এলাকার নারায়ণপুর পাম্প থেকে শুরু করে সীমাবাঁধ, উকিলের হাট, আশ্রম মোড়, বামুনের মোড়, হারউড পয়েন্ট, উপকূল থানা এলাকার ময়নাপাড়া, অক্ষয়নগর নতুন রাস্তার মোড়, লট ৮ মোড়, কামারহাট এলাকায় চাঁদা উঠছে দিনের বেলাতেও। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, রাতে ঝামেলা আরও বাড়ে। গঙ্গাসাগরমুখী ট্যুরিস্ট বাসও চাঁদার জুলুমের শিকার।

সুষ্ঠু ভাবে ব্যবসায়ীদের আড়ত বা সিন্ডিকেট থেকে চাঁদা নেওয়া হয় না কেন? কেন রাস্তায় গাড়ি আটকানো হচ্ছে? বড় পুজো আয়োজকদের অনেকের দাবি, অনেক ছোট ছোট ক্লাব গজিয়ে উঠেছে। সেগুলি পাঁচ বছরের আগে পুজোর অনুমোদন পায় না। তারাই মূলত এ ভাবে চাঁদা তোলে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পশ্চিম) চন্দ্রশেখর বর্ধন বলেন, ‘‘আমরা সব জায়গায় নিয়মিত ভাবে অভিযান চালাচ্ছি। কাউকে চাঁদা তুলতে দেখলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী— সকলের কাছেই আবেদন করা হচ্ছে, যাতে তাঁরাও এগিয়ে এসে অভিযোগ দায়ের করেন।’’ পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, পুলিশের টহলদার গাড়ি দেখলেই চাঁদা তোলা বন্ধ রেখে রাস্তার পাশে সটকে পড়ছে ছেলেরা। পুলিশের গাড়ি চলে গেলেই ফিরে আসছে তারা। এ ভাবেই পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে চাঁদার জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে কিছু যুবক।

অন্য বিষয়গুলি:

kalipuja illegal extortion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy