এখানে লাগানো হয়েছিল ম্যানগ্রোভ। এখন ফাঁকা প্রান্তর। গাজিখালি খেয়াঘাটে। নিজস্ব চিত্র
সুন্দরবন এলাকায় বাঁধের ভাঙন রোখা-সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় ম্যানগ্রোভের গুরুত্বের কথা বার বার উঠে এসেছে। প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে সরকারের তরফে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়। কিন্তু অভিযোগ, রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে উদাসীন প্রশাসন। ধূমধাম করে বহু টাকা ব্যয়ে বছর বছর ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হলেও মাস ঘোরার আগেই নষ্ট হচ্ছে বীজ, মৃত্যু ঘটছে গাছের। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ম্যানগ্রোভ রোপণ চলছে, তা অধরাই থেকে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
স্থানীয় সূত্রের খবর, সাম্প্রতিক অতীতে সুন্দরবনে বিভিন্ন ব্লকের নদীর চরে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে অনেক জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে, সে সবের কোনও চিহ্ন নেই। কোথাও আবার কয়েক হাজার চারার মধ্যে বেঁচে রয়েছে গুটিকয়েক।
সন্দেশখালি ১ ব্লকের ন্যাজাট ২ পঞ্চায়েত এলাকার সমস্ত নদীবাঁধই বিপজ্জনক। পাটনিপাড়া এলাকায় বিদ্যাধরী নদীর চরে এক বছর আগে সরকারি ভাবে কয়েক হাজার ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, গাছের কোনও অস্তিত্বই নেই। এই পঞ্চায়েতের ৪ নম্বর পাড়ার বিদ্যাধরী নদীর চরে বছরখানেক আগে ম্যানগ্রোভের চারা লাগানো হয়েছিল। সেগুলি জাল ও বেড়া দিয়ে ঘিরেও দেওয়া হয়। তবে এখন না আছে জাল, না আছে চারা। হাতে গোনা দু’একটি গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা রঘুনাথ সর্দার বলেন, ‘‘এখানে চারা লাগানোর কয়েক দিনের মধ্যেই তা মরে যেতে শুরু করে। রক্ষণাবেক্ষণ তেমন কিছু করতে দেখিনি।’’ একই অবস্থা এই পঞ্চায়েতের গাজিখালি খেয়াঘাটের বিদ্যাধরী নদীর চরের। এখানে ম্যানগ্রোভের বেশ কয়েক হাজার বীজ রোপণ করা হয় কিছু মাস আগে। এখন পুরোটাই ধু ধু প্রান্তর।
এই ব্লকের শেয়ারা রাধানগর পঞ্চায়েতের নিত্যবেড়িয়া ঘটিহারা নদীর চর, শেয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকারও একই দশা। সন্দেশখালি ২ ব্লকের মণিপুর পঞ্চায়েতের বোয়ালিয়ার চক, গোপালের ঘাট, তালতলা ঘাট চত্বরে প্রত্যেক বছর ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়। তবে নদীর ভাঙনের জন্য এই অংশে বর্তমানে কোনও ম্যানগ্রোভ নেই। রোপণের সমস্ত টাকাই কার্যত জলে গিয়েছে। একই অবস্থা শিথলিয়া পোলপাড়া চত্বর ও শিথলিয়া পুরনো লঞ্চঘাট এলাকারও। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, অনেক সময়ে নদীতে যাঁরা মাছ ধরতে নামেন, তাঁরা বেড়া ভেঙে ফেলেন। ভাঙা জায়গা দিয়ে ছাগল-সহ অন্যান্য পশু ঢুকে চারা নষ্ট করে দেয়।
সন্দেশখালি ১ বিডিও সুপ্রতিম আচার্য বলেন, ‘‘কিছু কিছু ম্যানগ্রোভ নষ্ট হয়েছে বিভিন্ন কারণে। তবে অনেক জায়গায় ম্যানগ্রোভ বেঁচে আছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে সব ম্যানগ্রোভ বাঁচানো যায়। এ বিষয়ে বন দফতরের পরামর্শ নেওয়া হয়। রক্ষণাবেক্ষণের উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে।’’
হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের দুলদুলি পঞ্চায়েতের নেবুখালি ভেসেল ঘাটের কাছে বেশ কয়েক মাস আগে কয়েক হাজার ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়েছিল। তবে এখন একটা চারাও বেঁচে নেই। এখানকার প্রধান চঞ্চল মণ্ডল বলেন, ‘‘একদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের অসচেতনতা, অন্য দিকে মাটির সমস্যার জন্য বাঁচল না চারা। রক্ষণাবেক্ষণেও খামতি ছিল। তবে আমাদের পঞ্চায়েতের অনেক জায়গায় ম্যানগ্রোভ ভাল হয়েছে।’’
গোবিন্দকাটি পঞ্চায়েতের উত্তর মালেকান ঘুমটি মুসলিম পাড়ার নদীর চর, শ্রীধরকাটি কালিন্দী নদীর চরে বীজ রোপণ করা হয় কয়েক মাস আগে। বর্তমানে সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বীজের বদলে চারা রোপণ করলে ম্যানগ্রোভ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি হয়। যদিও ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ রোপণের ক্ষেত্রে চারা কিনে বসানোর নিয়ম নেই। বীজই রোপণ করতে হয়।
হিঙ্গলগঞ্জের সুন্দরবন ঘেঁষা কালীতলা পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে সন্দেশখালি, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, মিনাখাঁ ব্লকের সব পঞ্চায়েত ম্যানগ্রোভের বীজ কেনে। সেই বীজ নদীর চরে রোপণ করে ঘিরে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এ ভাবে বহু বীজ নদীর জলে ভেসে গিয়ে নষ্ট হয়। চারা বড় হওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ।
সন্দেশখালি ১ ও ২ ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন ধরেই ম্যানগ্রোভ রোপণে সাফল্য পেয়েছে একটি বেসরকারি সংগঠন। ওই সংগঠনের পক্ষে শুভাশিস মণ্ডল বলেন,‘‘আমরা দেখেছি বীজ ছড়িয়ে ম্যানগ্রোভ বড় করা মুশকিল। তাই আমরা ম্যানগ্রোভ চারা এনে লাগাই। এতে গাছের বেঁচে থাকার হার বেশি হয়।’’ একই মত পরিবেশবিদ সুদীপ্ত ভট্টাচার্যের। তিনি বলেন, ‘‘নদীর চরে বীজ ছড়ানোর থেকে চারা লাগানো বেশি কার্যকর।’’
ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, এক একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বীজ লাগাতে সব মিলিয়ে খরচ ধরা হয় প্রায় ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয় বীজের জন্য। বাকি টাকা বীজ রোপণ, বেড়া দেওয়া-সহ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে খরচ হয়। প্রতি বছর এত টাকা খরচ করা হলেও আখেরে কোনও লাভ হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন এলাকার মানুষ।
হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও শাশ্বতপ্রকাশ লাহিড়ী বলেন, ‘‘সরকারি নিয়ম মেনে ম্যানগ্রোভ বীজ কিনে রোপণকরা হচ্ছে। তবে কিছু ক্ষেত্রেম্যানগ্রোভ বাঁচানো যাচ্ছে না, তা ঠিক। তাই রক্ষণাবেক্ষণ যাতে সঠিক ভাবে হয় সে দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এলাকার মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy