Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
রাতে-পথে/ ১

রাতে এতটা পথ হেঁটে আসতে ভয় তো করেই

তেলেঙ্গনায় মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় তোলপাড় চলছে দেশ জুড়ে। তারই মাঝে থেমে নেই নতুন নতুন ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনা। রাতের পথে কতটা নিরাপদ মেয়েরা, প্রশ্ন উঠছে নানা এলাকায়। রাতে বনগাঁ শহরের পরিস্থিতি ঘুরে দেখল আনন্দবাজার।

সুনসান: ভোরের ট্রেন বনগাঁয়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

সুনসান: ভোরের ট্রেন বনগাঁয়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

সীমান্ত মৈত্র 
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০৭
Share: Save:

ভোর ৪টে। শীতের শুরুতে সুনসান বনগাঁ শহরের রাস্তাঘাট। হাতে গোনা দু’একটি চা-মিষ্টির দোকান সবে খুলেছে। যশোর রোড ধরে সাইকেল চালিয়ে বনগাঁ স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলেন এক তরুণী। আচমকা বাইকে করে দুই যুবক সাইকেলের পিছনে এসে জোরে জোরে হর্ন দিতে থাকল। যুবকদের মাথা-মুখ চাদর জড়ানো। তরুণী সাইকেলের গতি বাড়িয়ে অন্য গলিতে ঢুকে পড়লেন। কুয়াশার ভিতরে মিলিয়ে গেল বাইক।

পরিচয় হওয়ার পরে তরুণী জানালেন, কলকাতায় কাজে যাচ্ছেন। ভোর ভোরই বেরোতে হয় তাঁকে। বললেন, ‘‘এমনিতে সমস্যা হয় না। তবে আজ খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’’

বনগাঁ শহরের আমলাপাড়ায় থাকেন হৈমন্তিকা দাস। মডেলিং করেন। কাজের সূত্রে বহু জায়গায় যেতে হয়। অনেক সময়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়। জানালেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। এক রাতে ট্রেনের কামরায় এক ব্যক্তি অভব্য আচরণ করে। প্রতি দিন এমনটা হয় না ঠিকই। কিন্তু হৈমন্তিকা বলেন, ‘‘এখন আট বছরের শিশুই হোক কিংবা বৃদ্ধা— কেউই পথেঘাটে সুরক্ষিত নন। রাতে একা বাড়ি ফিরতে ভয় করে।’’ অচেনা এক যুবক কিছু দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ার উত্যক্ত করত তাঁকে। যোগাযোগ না রাখলে ক্ষতি করে দেবে বলে হুমকিও দেয়। হৈমন্তিকা বলেন, ‘‘ওই যুবককে ব্লক করে দিয়েছিলাম। পুলিশকে ঘটনার কথা জানিয়েছিলাম। ভয় লাগে, ওই যুবক নিশ্চয়ই আমার বাড়ির ঠিকানা জানে। কোনও দিন না যাতায়াতের পথে হাজির হয়।’’

তেলেঙ্গনায় মহিলা চিকিৎসককে রাতের রাস্তায় ধর্ষণ করে খুনের পরে মহিলাদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। বিশেষ করে যাঁরা রাতে ফেরেন বা খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরোন— তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।

তবে সমস্যাটা যে শুধু রাতের, তা নয় বলেই অনেক মহিলার অভিজ্ঞতা। গোবরডাঙার বাসিন্দা এক স্কুল শিক্ষিকা সম্প্রতি অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে কলকাতায় যাচ্ছিলেন। ট্রেনে তাঁর পাশের সিটে এক মাঝবয়সী ব্যক্তি বসেছিল। ভিড় ট্রেনে সিটে বসেই ওই ব্যক্তি শিক্ষিকার সঙ্গে অভব্য আচরণ শুরু করে। শিক্ষিকা তাকে ঠিকঠাক ভাবে বসতে অনুরোধ করেন। তারপরেও আচরণ থামেনি। বাধ্য হয়ে ওই শিক্ষিকা উঠে দাঁড়িয়ে পাশের সহযাত্রীর গালে সপাটে চড় কষিয়ে দেন। শিক্ষিকার কথায়, ‘‘এত কিছুর পরেও আমাকে কয়েক জন ট্রেন যাত্রীর কাছ থেকে শুনতে হল, ওঅ সহযাত্রীর যা বয়স, তাতে উনি এমন অভব্য আচরণ করতেই পারেন না। অর্থাৎ, দোষটা যেন আমারই।’’

বনগাঁ এবং সংলগ্ন এলাকা থেকে ভোরে ww মিষ্টি নিয়ে যান অনেক মহিলা। তাঁরা রাত ৩টে থেকে ভ্যানে বা হেঁটে বনগাঁ স্টেশনে পৌঁছন। তাঁদেরই একজন সুষমা মণ্ডল। বাড়ি পাঁচপোতায়। ভোর ৩টেয় উঠে চার কিলোমিটার পথ হেঁটে স্টেশনে আসেন।

ভয় লাগে না? মহিলার কথায়, ‘‘একা মহিলা, হেঁটে আসি, ভয় তো লাগবেই। তবে পেট চালাতে না বেরিয়ে উপায়ও তো নেই। পুলিশকে অবশ্য মাঝে মধ্যে দেখতে পাই রাস্তায়।’’

বনগাঁ থেকে অনেক মহিলা ভোরের ট্রেনে কলকাতা, বারাসত-সহ বিভিন্ন এলাকায় পরিচারিকার কাজে করতে যান। অনেকে জানালেন, দল বেঁধে যাতায়াতের চেষ্টা করেন। একা যাতায়াত করতে ভয় লাগে।

রাত ২টো বনগাঁ স্টেশনে দেখা হল এক যুবকের সঙ্গে। তিনি বৌ-বাচ্চা নিয়ে দিঘায় বেড়াতে যাচ্ছিলেন। বাড়ি থেকে ভ্যানে করে স্টেশনে এসেছেন। বললেন, ‘‘চারদিকে মহিলাদের উপরে অত্যাচারের ঘটনা শুনে খুবই ভয় লাগে। স্ত্রীকে নিয়ে রাতে বেরোতেও সে কথা মনে হচ্ছিল। তবে চেনা এলাকা বলে চলে এলাম।’’ পথে পুলিশের গাড়ি দেখতে পাননি বলেই জানালেন তিনি। দেখা গেল, কয়েক জন মহিলা প্ল্যাটফর্মে চাদর-কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন। রেল পুলিশের দেখা মেলেনি। কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে ভোর রাতে স্টেশনে ছাড়তে এসেছিলেন বাবা মনোহর বিশ্বাস। মেয়ে মধ্যমগ্রামে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যাচ্ছিলেন। মনোহর বলেন, ‘‘আগে মেয়ে একাই সাইকেল চালিয়ে ভোরে স্টেশন আসত। এখন চারিদিকে যা সব ঘটছে, তাতে আর ভরসা পাচ্ছি না। কষ্ট হলেও মেয়েকে স্টেশনে দিয়ে যাই। রাতে পুলিশের টহল তেমন চোখে পড়ে না।’’ রাতে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতাল চত্বরে দেখা গেল, রোগীর আত্মীয়া অনেকে অপেক্ষা করছেন। এক মহিলার কথায়, ‘‘নেশা করে কিছু যুবক হল্লা করে। গালিগালাজ করে। খুবই ভয় করে।’’

রাত ২টো থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বনগাঁ শহরের যশোর রোড, স্টেশন রোড, রামনগর রোড-সহ ঘুরে পুলিশের টহল চোখে পড়েনি।

তবে বাইকে দু’-তিনজন যুবক এলাকায় সন্দেহজনক ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নম্বর প্লেটহীন বাইকও চোখে পড়ল। রাতে যাতায়াত করা মহিলাদের বক্তব্য, মাঝে মধ্যে পুলিশ দেখা যায়। তবে রোজ থাকে না।

পুলিশের পক্ষে অবশ্য জানানো হয়েছে, রাতে টহল নিয়মিত থাকে। সিভিক ভলান্টিয়ার মোতায়েন থাকে। টোটো করেও পুলিশ টহল দেয়। বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদারের উদ্যোগে সম্প্রতি সিনিয়র এক করে অফিসার রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত নিজেও রাতে টহল দেন। পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘রাতের নিরাপত্তার দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। টহলদারি ভ্যান ছাড়াও হাইওয়ে পেট্রোল ভ্যান থাকে। সিভিক ভলান্টিয়ার থাকেন।’’

তবে রাতের সুরক্ষার জন্য এ সব কতটা যথেষ্ট, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বনগাঁর এক কলেজ পড়ুয়া তরুণীর কথায়, ‘‘পুলিশ তো বলবেই ওরা কাজ করছে। কিন্তু তারপরেও তো এত সব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে দেশ জুড়ে!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Bangaon Woman Safety
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy