১১ বছর আগের ২৫ সেপ্টেম্বর। পানিহাটির গান্ধীনগরের বাসিন্দা জ্যোৎস্না চক্রবর্তীর জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছিল। মোবাইল চোর সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল তাঁর স্বামীকে। দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও হাল ছাড়েননি পরিচারিকার কাজ করে সন্তানদের মানুষ করা জ্যোৎস্না। দোষীদের কঠিন শাস্তির দাবিতে ও স্বামীর ‘চোর’ তকমা মুছতে আইনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
সেই মাছ বিক্রেতা শম্ভু চক্রবর্তীকে গণপিটুনি দিয়ে খুনের মামলায় মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করল ব্যারাকপুর আদালত। তাতে পানিহাটি পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি তথা তৃণমূল পুরপ্রতিনিধি তারক গুহ-সহ পাঁচ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেন বিচারক। পরে এজলাসের বাইরে জ্যোৎস্না বলেন, ‘‘আদালতের রায়ে আমি খুশি। তার থেকেও বড় বিষয় হল, প্রমাণ করতে পারলাম, আমার স্বামী নির্দোষ ছিলেন। ওঁর উপর থেকে চোর
তকমা মুছতে পারলাম।’’ যদিও সাজাপ্রাপ্তদের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা হাই কোর্টে যাবেন। যা শুনে জ্যোৎস্না বলেন, ‘‘আমরাও লড়াই ছাড়ব না।’’
কিন্তু স্থানীয় মহলের প্রশ্ন, গণপিটুনি দিয়ে খুনের মামলায় জামিনে থাকা তারককে যদি ২০২২-এ পুরসভা নির্বাচনে টিকিট দেওয়া হতে পারে, তা হলে সেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কি আবারও বেরিয়ে আসবে ওই নেতা? দোষী সাব্যস্ত ও সাজাপ্রাপ্ত তারক এবং তার ভাই তথা পানিহাটি উদ্বাস্তু সেলের সভাপতি নেপালের বিরুদ্ধে কি দল আদৌ কোনও ব্যবস্থা নেবে?
পানিহাটির বিধায়ক নির্মল ঘোষ বলেন, ‘‘যে সময়ে ঘটনাটি ঘটেছিল, তখন তারক পুরপ্রতিনিধি ছিলেন না। একটি ঘটনায় মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে ওই কাণ্ড ঘটেছিল। তাতে কী ভাবে তারকের নাম জড়িয়েছে, জানি না।’’ বিধায়ক আরও বলেন, ‘‘অভিযোগ তো
থাকতেই পারে। তবে, তারক খুব ভাল ছেলে। এলাকায় এতটাই জনপ্রিয় যে, ওঁকে ভোটে হারানো কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে, এখন দোষী সাব্যস্ত ও সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় কী পদক্ষেপ করা হবে, দল সেই সিদ্ধান্ত নেবে।’’
২০১৪ সালে দুর্গাপুজোর মণ্ডপ তৈরির কাজ চলছিল গান্ধীনগরে। সেখানে ওই মণ্ডপ থেকে
মোবাইল চুরির অভিযোগ তোলা হয় শম্ভুর বিরুদ্ধে। তাঁর পরিজনদের অভিযোগ, সন্দেহের বশে মণ্ডপের বাঁশের সঙ্গে শম্ভুকে বেঁধে তারক, নেপাল-সহ আরও অনেকে মিলে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে তাঁর পাঁজর ভেঙে দেয়। পায়ুদ্বারে ঢুকিয়ে দেয় পাথর। সকালের এই ঘটনার পরে রাতে মৃত্যু হয় শম্ভুর। এই ঘটনায় তারক, নেপাল-সহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন জ্যোৎস্না। দু’জন পালিয়ে গেলেও তারক, নেপাল-সহ আট জন গ্রেফতার হয়। অবশ্য তারা সকলেই জামিন পেয়ে যায়। তখন থেকেই তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন বলে জানান জ্যোৎস্না।
গত শুক্রবার মামলার শুনানি ছিল। সে দিন জামিনে থাকা আট জনের মধ্যে মল্লিকা দে, নব
চক্রবর্তী, বুরন দাসকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিয়েছিলেন ব্যারাকপুর আদালতের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক অয়নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি, তারক, নেপাল, শ্যামল দাস, হরিপদ সরকার ও জয়দীপ মুখোপাধ্যায়কে দোষী সাব্যস্ত করে জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ পাঁচ জনকে আদালতে আনা হয়। বিচারক কী রায় ঘোষণা করেন, তা জানতে আদালতে ভিড় জমিয়েছিলেন তারকের অনুগামীরা।
দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ এজলাসে হাজির করানো হয় পাঁচ দোষীকে। বিচারক অয়নকুমার
বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে চান, তাদের কিছু বলার আছে কিনা? তাতে প্রত্যেকেই পারিবারিক সমস্যার কথা জানান। এর পরেই বিচারক পাঁচ জনকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা শোনান। সঙ্গে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, যা অনাদায়ে আরও ছ’মাসের কারাবাসের নির্দেশ দেন। সাজা শুনে কেঁদে ফেলে তারক ও নেপাল। অসুস্থ হয়ে পড়েন নেপালের স্ত্রী জুঁই গুহ। তাঁকে বাইরে নিয়ে যান পরিজনেরা। আর চোখে জল নিয়ে জ্যোৎস্না বলেন, ‘‘অনেক কষ্ট করে দুই ছেলেকে বড় করেছি। আজ ন্যায় বিচার পেলাম।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)