Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Fishermen of Kakdwip

ঝুঁকি নিয়েই চলছে সমুদ্র-যাত্রা

জলপথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে পাইপ ফেটে জল ঢুকে তলিয়ে গিয়েছে আস্ত একটি ট্রলার। মাছ নিয়ে ফিরছিল সেটি।

সমুদ্রে পাড়ি দিচ্ছে ট্রলার।

সমুদ্রে পাড়ি দিচ্ছে ট্রলার। নিজস্ব চিত্র।

সমরেশ মণ্ডল
কাকদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪ ০৯:২৬
Share: Save:

ইলিশের মরসুম এলেই সাগরে পাড়ি দেওয়ার জন্য সাজো সাজো রব সুন্দরবনের মৎস্য বন্দরগুলিতে। জোয়ারের টানে ট্রলার নিয়ে ভেসে পড়েন মৎস্যজীবীরা। যাঁরা বছরে বেশ কয়েক বার সমুদ্রে মাছ ধরতে যান, তাঁদের কাছে মে, জুনের অনেকটা সময় নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ থাকার পরে জুন শেষে মাছ শিকার করাটা সারা বছরের রোজগারের শুরু বলে মনে করেন। বর্ষার মুখে এই সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ জালে পড়ে। সুন্দরবন থেকে দশ-এগারো হাজার ট্রলার এই সময়ে মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে পাড়ি দেয়। প্রতি বছর এই সময়ে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলারডুবি, মৎস্যজীবীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রশ্ন ওঠে পরিকাঠামো নিয়ে। কিন্তু সঠিক উত্তর মেলে না কখনও।

এ বারও মরসুমের শুরুতে মাছ ধরতে সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া ট্রলারগুলির মধ্যে দু’টির দুর্ঘটনা ঘটেছে পর পর দু’দিন। জলপথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে পাইপ ফেটে জল ঢুকে তলিয়ে গিয়েছে আস্ত একটি ট্রলার। মাছ নিয়ে ফিরছিল সেটি। ওই ট্রলারে থাকা ১৮ জন মৎস্যজীবী সাঁতরে কাছাকাছি থাকা অন্য ট্রলাকে উঠে প্রাণে বাঁচেন। একই সময়ে তিন দিন নিখোঁজ থাকার পরে বাঘের চরের কাছে খোঁজ মেলে অন্য একটি ট্রলারের। ওয়্যারলেস সংযোগ ব্যবস্থা এই সব ট্রলারগুলিতে থাকলেও তা কিছু কিছু সময় কাজ করে না বা করলেও অন্য ‘স্পেকট্রামে’ চলে যায় বলে মৎস্যজীবীদের অভিযোগ। এর ফলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বিপদে পড়ার কথা জানাতে পারেন না তাঁরা।

ইলিশের মরসুমে সুন্দরবন এলাকা থেকে যাওয়া ট্রলারগুলির মধ্যে কিছু ট্রলার বেশি মাছ পাওয়ার আশায় বাংলাদেশের দিকে চলে যায়। আবহাওয়া খারাপ হলে রেডিয়ো মারফত তারা সময় মতো খবর পায় না বলে জানা যাচ্ছে। পরে জানতে পেরে তড়িঘড়ি ফিরতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানাচ্ছে মৎস্যজীবীদের সংগঠন।

গত কয়েক বছরে বঙ্গোপসাগরে বার বার দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে একের পর এক ট্রলার। দুর্ঘটনায় ট্রলার ডুবে ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মৎস্যজীবীদের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। অনেকে এখনও নিখোঁজ। মৎস্যজীবীদের একাংশের দাবি, নদীতে ট্রলার চলাচলের পথ নির্দিষ্ট করুক প্রশাসন। তা হলেই চর বাঁচিয়ে চলা সম্ভব হবে। দুর্ঘটনাও কমবে। সংযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি ট্রলারগুলির স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পরে ফের ট্রলারের পরিকাঠামোগত ত্রুটির বিষয়টি সামনে এসেছে। মৎস্যজীবীদের কয়েক জন বলেন, ‘‘প্রাণ হাতে নিয়ে সাগরে যাই আমরা। অন্য যানবাহনের মতো ট্রলারের স্বাস্থ্য পরীক্ষার তেমন কোনও ব্যবস্থাই নেই।’’

অনেক সময়ে নিষেধ অমান্য করে কিছু ট্রলার বাংলাদেশের জল সীমানায় গিয়ে মাছ ধরে বলে অভিযোগ। বাংলাদেশের উপকূল রক্ষী বাহিনী দেখতে পেয়ে তাড়া করলে দ্রুত পালানোর সময়েও দুর্ঘটনা ঘটে। অন্য ভারতীয় ট্রলার এই পরিস্থিতিতে উদ্ধার করতে যাওয়ারও সাহস দেখায় না। এ ছাড়া, মাঝসমুদ্রে আবহাওয়া খারাপ হলে দ্রুত সমুদ্র লাগোয়া খাঁড়ি, জম্বুদ্বীপ, কেঁদোদ্বীপ বা সাগরের দিকে আসার সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে। ওই দ্বীপ এলাকার সমুদ্র বা নদীর মোহনার মুখে চর পড়ে যাওয়ায় গভীরতা কম। ট্রলারগুলির মাঝিরা জানান, সে ক্ষেত্রে জলোচ্ছ্বাস হলে বড় ঢেউয়ের নীচের গভীরতা মাপা যন্ত্র (ফিস ফাইন্ডার) কাজ করে না। এর ফলে চরে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে।

একই সঙ্গে অদক্ষ মাঝিদের জন্যও দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ মৎস্যজীবী সংগঠনের অনেকের। এক বছর নৌকো বা ভুটভুটি চালিয়েই কেউ হয় তো পরের বছর ট্রলারে সহকারী মাঝি হয়ে পাড়ি দিচ্ছেন গভীর সমুদ্রে। তার পরের বছর হয় তো তিনিই মূল মাঝি! অনভিজ্ঞতার কারণে বিপদ মোকাবিলা করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে।

মৎস্যজীবীদের প্রাণহানির পিছনে লাইফ জ্যাকেট পরার অনীহা আরও একটি বড় কারণ বলে জানাচ্ছেন অনেকে। মাছ ধরে ফেরার পথে মৎস্যজীবীরা লাইফ জ্যাকেট পরছেন কিনা, তা নিয়ে মৎস্য দফতরের কোনও নজরদারি নেই। যাঁরা জ্যাকেট ব্যবহার করবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করেন অনেকে। কিন্ত গভীর সমুদ্রে গিয়ে নজরদারির মতো পরিকাঠামো নেই দফতরের।

পূর্ব মেদিনীপুর বা অন্ধপ্রদেশ, কেরলে ট্রলারের আকৃতি ‘ইউ’ মডেলের। তা তুলনায় বেশি সুরক্ষিত। কিন্ত সুন্দরবন এলাকার সমস্ত ট্রলার ‘ভি’ মডেলের হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে বলেও অভিযোগ মৎস্যজীবীদের অনেকের। ট্রলার তৈরির ক্ষেত্রেও বছরের পর বছর ধরে কোনও নিয়ম নেই। বহু বছর ধরে মালিকেরা একই মডেলের ট্রলার তৈরি করে আসছেন।

কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বিজন মাইতি বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার পিছনে মৎস্যজীবীরা কিছুটা দায়ী। দ্বিতীয়ত, নদীতে চর। জোয়ার-ভাটা ও সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাসের পরিস্থিতি অনেকেই মাথায় রাখেন না।’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সহ মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) সুরজিৎ বাগ বলেন, ‘‘নদী বা সমুদ্রে চর পড়ে গিয়ে নাব্যতা কমে যাওয়ায় ট্রলার দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া, বেশি মাছ নিয়ে ফেরার সময়ে ট্রলারের নীচের অংশ বসে গিয়ে চরে ধাক্কা খাচ্ছে। জ্যাকেট পরার বিষয়ে প্রতিটি শিবিরে মৎস্যজীবীদের বলা হয়েছে। মৎস্যজীবীদের সংগঠনগুলি এ বিষয়ে নজর দিলে ভাল হয়।’’

অন্য বিষয়গুলি:

kakdwip Sagar Island
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy