বিপর্যয়: বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় ঢেকেছে আকাশ। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
সেই একই শব্দ, সেই আগুনের লেলিহান শিখাটা। মিল হতাহতের সংখ্যাতেও। ঘটনাস্থলও এক— নৈহাটির দেবক। দু’বছর আগের ঘটনা।
শুক্রবার দেবকের মধ্যপাড়ার বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পরে গ্রামের বাসিন্দাদের মনে পড়ছে বছর দু’য়েক আগের সেই বিস্ফোরণের কথা। সেবারও বিস্ফোরণে চার জনের মৃত্যু হয়েছিল। শুক্রবার যেমন প্রাণ হারালেন বাজি কারখানার চার শ্রমিক।
কিন্তু তার পরেও গ্রামে বাজির কারবার বন্ধ যে হয়নি, তার উদাহরণ আগেও মিলেছিল। আরও ভাল করে মিলল শুক্রবার দুপুরে। গ্রামের দুই বাসিন্দা এবং পড়শি গাঁয়ের দুই বধূর লাশ দেখল সেই দেবক। তার পরেও গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, দিন কয়েক কাটলে আবারও সেই কারবার শুরু হবে। তাঁরাই শুরু করবেন। কারণ, বাজি বানানো ছাড়া তাঁরা বাঁচবেনই বা কী করে!
শুক্রবার বিস্ফোরণের পরে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। এত কিছুর পরে, কেন বন্ধ হয় না অবৈধ বাজি কারখানা? সব কিছু জানার পরেও কেনই বা পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না? পুলিশ বলছে, অভিযান, বাজেয়াপ্ত, গ্রেফতার সব কিছুই হয়। কিন্তু জেল থেকে ফিরে গ্রামের বাসিন্দারা সেই একই পেশাতে ফিরে যান। তাই প্রাণহানি হলেও দেবকে বন্ধ হয় না বাজির কারবার। রমরমিয়ে চলে কারখানাও।
শুধু দেবকই নয়, গত পাঁচ বছরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নানা জায়গার বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে। গত বছর কাঁচরাপাড়ার বাজির কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল দুই শ্রমিকের। তার আগের বছর হালিশহর পুরসভা এলাকার মধ্যে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় তিন শ্রমিকের। বছর তিনেক আগে বিস্ফোরণ হয়েছিল আমডাঙায়। তার আগের বছরে দত্তপুকুরের বাজি কারখানায় মৃত্যু হয়েছিল চার শ্রমিকের। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও এলাকাতেই বন্ধ হয়নি বেআইনি বাজি কারখানা।
দেবক গ্রামে মোট ৮০০ পরিবারের বাস। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সামান্য কয়েকজন বাসিন্দার অল্পসল্প কৃষিজমি রয়েছে। বাকি যাঁরা অন্য কোনও পেশায় গিয়েছেন, বা চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা গ্রাম ছেড়েছেন। গ্রামের বাকিদের পেশা বাজি তৈরি। পুলিশ বলছে, গ্রামের সকলেই বাজি তৈরি করেন এমনটা নয়। তবে বাজির কারবারের সঙ্গে প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে কেউ না কেউ জড়িত। কেউ কাঁচামালের জোগান দেন, কেউ বা তৈরি বাজি চালান দেন বাজারে।
গ্রামে যেমন কারখানা রয়েছে, তেমনই বাড়িতে বাড়িতেও বানানো হয় নানা রকমের বাজি। অনেকেই বাজির মসলা দিয়ে মজুরির ভিত্তিতে বাজি তৈরি করিয়ে নেন। গ্রামের মহিলারাও বাড়িতে বসে অবসর সময়ে বাজি তৈরি করেন। আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, পুলিশ দেখেও দেখে না। পুলিশ চাইলে বাজির কারবার ঠিক বন্ধ হত। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘পুলিশ যদি নিয়মিত অভিযান চালায়, তা হলে কতদিন আর কারবার ধরে রাখতে পারবে ওরা?’’ এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, বাম আমল থেকেই বাজির কারবারিরা শাসক দলের ছত্রছায়ায়। তার ফলে তাদের বাগে আনা যায় না। পুলিশ বলছে, এলাকায় কোথাও বৈধ বাজি কারখানা নেই। যেগুলি আছে, তাঁদের কোনও অনুমতিই নেই। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘বারবার অভিযান হয়। বাজি বাজেয়াপ্ত হয়। কারবারিদের গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু কারবার বন্ধ হয় না। ২০০৫ সালে আমি ব্যারাকপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলাম। তখনও নিজে অভিযান চালিয়ে দেখেছি। বন্ধ করলেও, ফের চালু হয়ে যায়।’’ অভিযানে গিয়ে পুলিশকে আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে, এমন উদাহরণও রয়েছে। গত কালীপুজোয় দেবক থেকে ৬০০ কেজি বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। তার পরে অভিযানে গিয়ে গ্রামে ঢুকতে পারেনি পুলিশ। মহিলারা সামনে দাঁড়িয়ে তাদের বাধা দিয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল বছর দেড়েক আগেও। সেবকে পুলিশকে আক্রমণ করেছিল বাজির কারবারিরা।
তা হলে সমাধান সূত্র কী?
পুলিশ কমিশনার বলছেন, ‘‘বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা না করে বাজির কারবার বন্ধ করলে সাফল্য আসবে না। আমরা সেটাই চেষ্টা করব। বাজি কারবারিদের কীভাবে পুনর্বাসন দেওয়া যায়, তা নিয়ে আমরা আলোচনায় বসব। এটা বন্ধ করতেই হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy