ভিড় কমছে ইছামতী নদীতে। — ফাইল চিত্র।
পর্যটকদের হতাশ করল টাকির বিসর্জন-দৃশ্য। নদীর দু’পাড়ে ভিড়ও ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় কম।
ইছামতীতে দুর্গাপুজোর ভাসান কার্যত দুই বাংলার মিলন উৎসবে পরিণত হয়। চিরাচরিত এই প্রথা অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। এ বছর দেখা গেল, কার্যত ইছামতীতে দুই বাংলার ভাসান-উৎসব নেহাতই অনুজ্জ্বল।
অথচ, করোনা-কাল পেরিয়ে এবার প্রতিমা নিরঞ্জনে টাকিতে প্রচুর ভিড় হবে ধরে নিয়েছিলেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। বিএসএফ কর্তাদেরও সে রকমই ধারণা ছিল। হোটেল বুকিংও হয়েছিল আশানুরূপ। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং প্রশাসনের সঙ্গে এ দেশের আধিকারিকদের বৈঠকেও এ সব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেই মতো প্রস্তুতি ছিল দু’পক্ষের। কিন্তু তেমন ভিড় জমেনি নদীর দু’পাড়ে। স্থানীয় মানুষজনের উপস্থিতিও ছিল কম। পুজো উদ্যোক্তারাও অনেকে নৌকো ভাড়া করে প্রতিমা নামাননি ইছামতীতে।
বুধবার, দশমীর দিন টাকির বিসর্জনে বাংলাদেশের জলসীমায় মাত্র ছোট ছোট দু’টি নৌকা বাংলাদেশের দিকে দেখা গিয়েছে। তাতে কোনও প্রতিমাও ছিল না। সামান্য কিছু মানুষ বাংলাদেশের দিকে নদীর পাড়ে জড়ো হয়েছিলেন। ভারতের দিকেও নদীতে নৌকা নেমেছিল সব মিলিয়ে গোটা ৬০। অথচ, অনুমোদন ছিল দেড়শোটির। এর মধ্যে খুব জোর ১০টি প্রতিমা নৌকোয় তোলা হয়েছিল ভাসানের জন্য। প্রায় ২৫টি প্রতিমা টাকি রাজবাড়িঘাটেই নিরঞ্জন হয়।
ইছামতীর এ পাড়েও উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়েনি। হোটেল বুকিং থাকলেও বহু পর্যটক নদীর ধারে না গিয়ে হোটেলেই সময় কাটিয়েছেন বলে জানা গেল।
কেন ইছামতীতে দুই নৌকোর মাঝে প্রতিমা রেখে বিসর্জনের উৎসাহ দেখা গেল না?
পুজো উদ্যোক্তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নৌকো ভাড়া বাঁচাতে অনেকে ইছামতীতে বিসর্জন এড়িয়ে গিয়েছেন এ বার। ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য নৌকো ভাড়া পড়ছে ১০-১২ হাজার টাকা। এ ছাড়াও আনুষঙ্গিক আরও কিছু খরচ আছে।
টাকির থুবা ব্যায়াম সমিতির তরফে সৈকত মণ্ডল জানান, গত কয়েকবারের মতো এবারও রাজবাড়িঘাট থেকে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। নৌকোয় প্রতিমা তুলে বিসর্জন দিতে গেলে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ পড়ে যায়। এই অতিরিক্ত খরচ করা মুশকিল। এ ছাড়া, অনেক লোকবল লাগে নৌকোয় প্রতিমা তুলতে। তা পেতেও সমস্যা হয়।
টাকি অগ্রদূত ক্লাবের তরফে অভিষেক ঘোষ বলেন, ‘‘নৌকো ভাড়া-সহ আনুষঙ্গিক খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকা। তাই নৌকোয় তুলে প্রতিমা নিরঞ্জন করিনি আমরা।’’
রাজবাড়িঘাটের পরিকাঠামো ভাল না হওয়ায় সেখান থেকে প্রতিমা নৌকোয় তুলে বিসর্জন দেওয়া যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বলেও মত অনেক পুজো কমিটির।
টাকির উপ পুরপ্রধান ফারুক গাজি বলেন, “ঘাট সংস্কার আগামী বছরের আগে হয়ে যাবে। বোট ভাড়া বেশি নিচ্ছিল আমি বলে অনেক ক্ষেত্রে কম করিয়েছি। পরেরবার চেষ্টা করা হবে, যাতে ভাড়া কম হয়।”
যাঁরা প্রতিমা নৌকোয় তুলবেন, তাঁদের ফারুক নিজেই ৩ হাজার করে উৎসাহভাতা দেবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন বলে জানালেন। তাতেও উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না বলে তাঁর আক্ষেপ।
আর একটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন টাকির পৌর ক্লাব সমন্বয় কমিটির সম্পাদক সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এবার ভিড় কম কেন, তা নিয়ে তাঁর মত, আগে বিসর্জনের দিন নদীর মাঝ বরাবর নিয়ন্ত্রণরেখা তৈরি হত না। ফলে দুই দেশের নৌকো অবাধে আসা-যাওয়া করত। কিন্তু বিসর্জনের দিন দুই দেশের নৌকো কাছাকাছি চলে এলে কিছু মানুষ অন্য দেশের নৌকোয় উঠে সে দেশে চলে যেতেন। টাকিতে বিসর্জনের একদিন পরে হিঙ্গলগঞ্জে বিসর্জন হয়। এই সময়ের মধ্যে যে যাঁর আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরে বা কাজ মিটিয়ে হিঙ্গলগঞ্জে বিসর্জনের দিন সেখানে দু’দেশের নৌকো কাছাকাছি এলে টুপটাপ করে লাফ দিয়ে যে যাঁর দেশের নৌকোয় উঠে পড়তেন।
দু’দেশের নিরাপত্তার জন্যই বিষয়টি চিন্তার ছিল। ২০১২ সাল নাগাদ একবার খুব বেশি পরিমাণে এই ঘটনা ঘটে। তারপর থেকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী নড়েচড়ে বসে। ক্রমশ শুরু হয় কড়া নিয়ন্ত্রণ। গত কিছু বছর ধরে ইছামতীর মাঝ বরাবর নিয়ন্ত্রণরেখা তৈরি করা হয়। ফলে দুই দেশের নৌকো জলসীমা অতিক্রম করতে পারে না। কাছাকাছিও যেতে পারে না। সুব্রত-সহ স্থানীয় অনেকের মতে, এর ফলে নদীতে নেমে বিসর্জন উপভোগ করার আগ্রহ কমেছে।
অন্যান্যবার বিসর্জন উপলক্ষে সমস্ত হোটেল আগে থেকেই বুকিং হয়ে যেত। বাইরে থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসতেন দুই বাংলার প্রতিমা নিরঞ্জন দেখতে। এবার সে ভিড়টাও অনক গুণ কম।
ব্যান্ডেলের কেওটা থেকে এসেছিলেন দেবযানী ব্রহ্ম। তাঁর কথায়, ‘‘ভেবেছিলাম এবার করোনাকালের পরে বিসর্জন খুব জমজমাট হবে। পরিবারের অনেককে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু হতাশ হলাম। আর টাকিতে বিসর্জন দেখতে আসার ইচ্ছে নেই।”
বারাসত থেকে এসেছিলেন ববিতা দত্ত। তিনিও নিরাশ।
হোটেল বুকিং খুব ভাল ছিল। কোন ঘর ফাঁকা ছিল না। জানালেন টাকি ট্যুরিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রদ্যোৎ দাস। কিন্তু সেই ভিড়ের সবটা যে নদীর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছয়নি, সে কথা মানছেন তিনিও। হোটেল মালিকদের কারও কারও মতে, অতিরিক্ত ভিড়, হুড়োহুড়ির আশঙ্কাতেই হয় তো অনেক পর্যটক হোটেলে শুয়ে-বসে থাকতে পছন্দ করেছেন। যার ফলে, আদতে সেই পরিচিত ভিড়টাই উধাও টাকিতে।
b
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy