নদী-টপকে: ইছামতীতে চলছে বেআইনি পারাপার। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
বাংলাদেশ থেকে বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে চোরাপথে এ দেশে আসতে হলে যোগাযোগ করতে হয় এই সব সিন্ডিকেটের সঙ্গে। দু’দেশের সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে যাদের জাল।
কী রকম সেই সিন্ডিকেট? এলাকার মানুষের কথা এর নাম ‘ধুর-সিন্ডিকেট’। চোরাপথে যারাই দু’দেশের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে, তাদের চিহ্নিত করা হয় ‘ধুর’ শব্দটি দিয়ে। এদের মধ্যে রয়েছে অনেক মেয়েও, যাদের কাজের প্রলোভন দেখিয়ে এ দেশে এনে পাচার করা হয় মুম্বই-দিল্লি সহ দেশের বড় বড় শহরের নিষিদ্ধপল্লিতে। আর এই ‘ধুর’ পাচারের কারবার যাতে ভাল ভাবে চলতে পারে, সে কথা ভেবেই তৈরি হয়েছে ‘ধুর-সিন্ডিকেট’।
বনগাঁ ও বসিরহাট সীমান্ত এলাকা থেকে বিএসএফ ও পুলিশ প্রায় রোজই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের আটক করছে। কিন্তু ধরপাকড়ের পরেও চোরাপথে মানুষ পারাপার পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। অভিযোগ, সম্প্রতি ফের তা বাড়তে শুরু করেছে। বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় কাঁটাতার না থাকার সুযোগে শেষরাতে বা ভোররাতে ‘ধুর পাচার’ বাড়ছে। ইছামতী নদী-সহ বিভিন্ন জলপথ ব্যবহার করেও চলে পারাপার।
‘ধুর-সিন্ডিকেট’ অবশ্য অনেক। নিজেদের মধ্যে কারবার নিয়ে রেষারেষিও রয়েছে। কয়েক বছর আগে পেট্রাপোলে এক যুবককে কুপিয়ে খুন করা হয়। ওই খুনের পিছনে ‘ধুর-পাচার’ কারবারের দখল নেওয়ার বিষয়টি ছিল বলে পুলিশ জানতে পারে। পেট্রাপোল থানা এলাকা দিয়ে এখন রমরমিয়ে চলছে ধুর-পাচার। সীমান্তে বসবাসকারী মানুষের আভিযোগ, পাচার বন্ধ করতে পেট্রাপোল থানার পুলিশ উদাসীন।
কয়েক মাস আগে হাবড়া থানার পুলিশ মছলন্দপুর এলাকার একটি বাড়িতে হানা দিয়ে ধুর-সিন্ডিকেটের দুই মাথাকে গ্রেফতার করেছিল। তাদের জেরা করে পুলিশ জানতে পারে, চোরাপথে আসা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে তারা আড়াই হাজার টাকা করে নেয়। সীমান্ত থেকে এনে তাদের প্রথমে মছলন্দপুরে ওই চক্রের সদস্যেদের বাড়িতে রাখা হয়। পরে সুযোগ বুঝে তাদের হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া হয়। হাওড়াতেও ওই চক্রের লোকজন আছে। সেখান থেকে চেন্নাই, মুম্বই, পুণে বেঙ্গালুরু, দিল্লি-সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তাদের পাঠানো হয়।
কী ভাবে কাজ করে এই সিন্ডিকেটগুলি? পুলিশের বক্তব্য, দু’দেশের সীমান্তেই রয়েছে ওই চক্রের আড়কাঠিরা। তারা নিজেদের মধ্যে মোবাইলে যোগাযোগ রাখে। বাংলাদেশের গরিব পরিবারের মেয়েদের এ দেশে ভাল বেতনের কাজের প্রলোভন দিয়ে আনা হয়। তাদের পাচার করা হয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।
সীমান্ত পেরিয়ে দেশের নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছতে প্রয়োজন হয়, ঘাটমালিক, লাইনম্যান, লিঙ্কম্যান। পুলিশ বিএসএফের নজর এড়িয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়ে লিঙ্কম্যানদের উপর। সীমান্তের যে সব এলাকায় পাহারা বেশি থাকে সখান থেকে পার করতে হলে বাড়তি টারা লাগে। পুলিশ জানায়, সীমান্তের বাসিন্দারদের একাংশের সঙ্গেও সিন্ডিকেটের সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশিদের আত্মীয় সাজিয়ে সাময়িক ভাবে তারা বাড়িতে রেখে দেন। তার জন্য তারা পারিশ্রমিকও পান সিন্ডিকেটের কাছ থেকে। ওই বাড়ি থেকেই শুরু প্রশিক্ষণও। কী রকম?
পাচারের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যাক্তি জানান, বাংলাদেশি মহিলাদের এ দেশে এনে শাড়ির বদলে চুড়িদার পরানো হয়। কপালে সিঁদুরও দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের লোকেরা তাদের পাখি পড়ানোর মতো করে বুঝিয়ে দেন, ট্রেনে, বাসে, অটোতে তারা যেন বেশি কথা না বলেন। কারণ বেশি কথা বললে উচ্চারণের ভঙ্গি দেখে তাদের বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। লুঙ্গির বদলে পুরুষদের পরানো হয় শার্ট-ট্রাউজার্স। বাড়তি সর্তকতা হিসাবে বাংলাদেশের দেশলাই বিড়ি, সিগারেট, ব্যবহার বন্ধের নির্দেশও দেওয়া হয়।
তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশিরা সর্বস্ব হারান। অতীতে বনগাঁ শহরের পশ্চিমপাড়া এলাকায় কয়েকজন বাংলাদেশিকে পুলিশ উদ্ধার করে। তাদের কোনও দালাল সেখানে ফেলে দিয়ে পালিয়েছিল।
অভিযোগ, সীমান্তে তাদের কাছে থাকা টাকা দালালেরা ছিনিয়ে নিয়েছিল। ধুর-পাচারকারীদের সঙ্গে এ দেশের পরিচয়পত্র তৈরি চক্রের যোগাযোগ আছে। তারা মোটা টাকার বিনিময়ে এ দেশের জাল পরিচয়পত্রও বানিয়ে বিক্রি করে বাংলাদেশিদের কাছে।
পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদার বলেন, ‘‘ধুর-পাচার বন্ধ করতে নিয়মিত অভিযান চলছে। থানাগুলোকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশিদের পাশাপাশি দালালদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’’
এ নিয়ে কী বলছে রাজনৈতিক নেতারা? বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা যে কোনও ধরনের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে। আগামী দিনে অনুপ্রবেশ রুখতে আরও কড়া অবস্থান নেওয়া হবে। বিএসএফ সীমান্তে ভাল কাজ করছে।’’
অন্যদিকে, জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘সীমান্তে পাহারা দেয় বিএসএফ। অনুপ্রবেশ বন্ধ করা ওদেরই মূল দায়িত্ব। অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। চোরাপথে এসে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা এখানে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি হাবড়ার বিডিও আবাসনে ডাকাতির ঘটনাতেও বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের যোগ পাওয়া গিয়েছে।’’
এই কারবার বন্ধ হোক চান সকলেই। আর তা শুনে হাসে ধুর-সিন্ডিকেটের মাথারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy